রূপকথা


ছোটবেলায় পড়েছিলাম রবির ইলাকে বলা গল্প। সেই গল্পে রাজার বাড়ি ছিল। ছোট্ট মনে ভেবে রেখেছিলাম সাতমহলা সেই বাড়ির ছবি... সেই ছবিতে সিংহদুয়ার ছিল, বিশাল বড় দালানকোঠা ছিল আর ছিল অনেক সুন্দর সুন্দর মানুষ তাদের নিজেদের আলো-আলো মন নিয়ে। বাবা মার সঙ্গে যেদিন পরীক্ষা দিতে গেলাম সেদিনই মন বলে উঠেছিল এই তো সেই বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা রাজবাড়ি। গোটা বাড়িটাই একটা ছবি। মেহগনি কাঠের দরজা তাতে পিতলের মুঠ - গ্ল্যামার কী! সবুজ ঠাকুরদালান, লাল চকচকে মেঝে আর শ্বেতপাথরের ঠান্ডা সিঁড়ি। এক্সকুইজিট। ঢুকেই বাঁদিকে ভারতবর্ষর ম্যাপ খোদাই করা দেওয়ালে। আজও যখন স্কুল যাই ঠাকুরদালানে দুদন্ড বসি, মনটা জুড়িয়ে যায়। 
ওই চারচৌকো উঠোনটা ছিল আমাদের খেলার জায়গা। খো খো, কবাডি, লক এন্ড কি সে কত খেলা! সব নাম আজ মনেও নেই। স্বাধীনতা দিবস, আগমনী, যুবদিবস প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে অফুরন্ত আনন্দের উৎস ছিল ওই উঠোনটা। দোতলায় ছিল আমার সবথেকে প্রিয় ঘরটা-লাইব্রেরী ঘর। চারদিকে শুধু বই বই আর বই। দেওয়াল জোড়া ছাদছোঁয়া সব আলমারি আর মাঝে নীচু টেবিলের পাশে কার্পেটের আসন- মনে হতো স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তো সে এখানেই। কত যে নতুন নতুন লেখকের সাথে পরিচিত হয়েছি স্কুলে- বীথিদি পড়তে দিয়েছিলেন সকালবেলার আলো- মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম বইটা। সুকৃতিদি পরিচয় করিয়েছিলেন নারায়ণ স্যানালের লেখনীর সাথে, মুজতবা আলী প্রথম পড়া প্রভাতীদির কাছে- সমৃদ্ধ হয়েছি, জেনেছি, শুধু নিয়েই তো গেছি ঝুলি ভরে।
মেন বিল্ডিং থেকে ক্রিস্টিন বিল্ডিং এর মাঝে ছিল হস্টেল আর একটা জমিতে কিছু গাছ আর একটা ছোট্ট ঘাসজমির বাগান। সায়েন্স বিল্ডিং-এর সিঁড়ির ধাপগুলো যেখানে কত্ত দিনের কত গোপন কথার ভাঁড়ার উজাড় করে দিয়েছি বন্ধুদের কাছে, কত কান্না হাসি, অভিমান, ক্যান্টিনের আলুকাবলি ভাগ করে খাওয়া - এখনও কত বাস্তব কত আপন!


কত্ত বছর হয়ে গেছে আমার এইখানে নিয়মিত আসার বৈধ অধিকার শেষ। কিন্তু ওই যে সোজা থামের পরে থাম, লাল বারান্দায় রোদের আঁকিবুকি, সোজা খোলা দরজাগুলো, দরজা জানলার খড়খড়ি, ক্লাসরুমের বেঞ্চগুলো এদের কাছে আমৃত্যু কৃতজ্ঞ আমি, এরাই তো এখনও বুঝিয়ে দেয় অধিকার আছেএখনও একইভাবে। আমার, আমাদের, আমাদের সময়ের এই বিশেষণগুলো তো চিরকালীন।
আমাদের ইস্কুল, আমাদের নিজেদের ইস্কুল আমাদের পড়াশোনার বাইরেও আরও অনেককিছু দিয়েছে। যতটুকু যা হয়েছি, যতটুকু মানুষ হতে পেরেছি, যেটুকু জীবনবোধ তৈরি হয়েছে সেটার অনেকটাই স্কুল থেকে। খুব ভালো ছাত্রী হয়তো ছিলাম না কোনওদিনই, কিন্তু খুব গর্বের সঙ্গে আজ বলতে পারি যে আমি হয়তো অনেকের থেকে ভালোভাবে জীবনটাকে দেখতে পারি এবং সেটা সম্পূর্ণ ভাবে স্কুলের জন্যই। স্কুলই তো শিখিয়েছিল শুধু নিজের জন্য বাঁচাটা বাঁচা নয়, অন্যদের জন্যও ভাবতে হয়, ভাগ করে নিতে হয়। শিখিয়েছিল সততা আর ভালোবাসা আমাদের নিত্যদিনের জীবনধারণের অঙ্গ হওয়া উচিত। ভুল তো হতেই পারে সেটা অন্যায় নয় কিন্তু সেটা স্বীকার না করাটা অন্যায়
যে শিক্ষা পেয়েছি, আজও পেয়ে চলেছি, জানি না কতটা কাজে লাগাতে পারি কিন্তু এটা নিশ্চিত করে জানি স্কুল ছাড়া আমি.. আমরা আজও অসম্পূর্ণ। 


তৃণা ঘোষাল [২০০২]

1 comment: