‘সেন্টিনারি’, ‘প্ল্যাটিনাম জুবিলি’ এই কথাগুলো প্রথম শিখেছিলাম
১৯৯৭ সালে, যে বছর ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের মন্তেসরি বিভাগ থেকে আমাকে চালান করা
হয়েছিল ৫ নং, নিবেদিতা লেন, পোস্টঅফিস বাগবাজারে। এমনিতে শেষের ক'টা দিন ব্রাহ্ম বালিকা
বিদ্যালয়ে কেটেছিল খারাপ। পুল-কার এবং দিদিরা বড্ড র্যাগিং করত আমার।
ন্যালাক্ষেপিদের যা পরিণতি হয় আর কি সবসময়! তেমনিই এক অমোঘ বিকেলে সাশ্রুনয়নে
বাবাকে অনুযোগ করেছিলাম ইশকুল বদলে দেওয়ার কথা। ততদিনে অন্য অনেক স্কুলের
প্রবেশিকার মধ্যে নিবেদিতা স্কুলেও আমার গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স দিয়ে এসেছিলাম।
কোনওদিনই আমার বাবা-মা আমাকে পড়াশোনা নিয়ে পাখিপড়া করায়নি। ৬ বছর বয়সে নতুন একটা
ইশকুলবাড়িতে পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি প্রশ্ন এসেছে “কার মাথায় শিখীপুচ্ছ আছে?” ততদিনে মিশিমাখা শিখীপাখা পড়া হয়ে গেছে, কিন্তু
তবুও সেদিন শিশিবোতলের জায়গাটা একটু শক্ত ঠেকেছিল।
এমনিতে ভগিনী নিবেদিতা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ের
প্রার্থনাকক্ষে লেডি অবলা বোসের একটি তৈলচিত্র ছিল। বাবা বলেছিল ইনি বিজ্ঞানী
জগদীশচন্দ্র বোসের বউ। দেখেছিলাম ওঁর ঠোঁটের ওপর হালকা গোঁফ আছে। ততদিনে দেখেছি গোঁসাইদিদার (যিনি
আমার ঠাকুমার প্রাণের বন্ধু ছিলেন, ইরা গোস্বামী, গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে) হালকা
গোঁফ আছে। গোঁফ নিয়ে আমার হালকা খারাপ লাগা ছিল। ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ে স্নো
হোয়াইট নাটকের সময় পাঁচ বছর বয়সে জল্লাদের ভূমিকায় অভিনয়ের কারণে আমাকে গোঁফ এঁকে
দেওয়া হয়েছিল। সহপাঠিনীকে ফ্রিল দেওয়া ড্যান্সিং গাউন পরে স্নো হোয়াইট সাজতে দেখে,
নিজের গোঁফে তা দিতে কেনই বা ভাল লাগবে? নিবেদিতা ইশকুলে নাম ওঠার পর বাবা বলেছিল
ভগিনী নিবেদিতা মেমসাহেব হয়েও আমাদের দেশে এসে ভাল ভাল কাজ করেছেন আর ইনি আমার
আগের ইশকুলের প্রার্থনাকক্ষে তৈলচিত্রে অঙ্কিত অবলা বোস আর তাঁর বরের খুব বন্ধু
ছিলেন। ভগিনী নিবেদিতাকে প্রথম দিন বড়বাড়িতে (মাধ্যমিক বিভাগ) ঢোকার মুখে ছবিতে
দেখে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। নাহ, এঁর গোঁফ নেই। সাদা ড্যান্সিং গাউন পরে আছেন, কোমরে
দড়ি বাঁধা, একটা রুমাল গোঁজা তাতে। মাথার চুলটা চুড়ো করে বাঁধা মেমসাহেবের, কার
দিকে তাকিয়ে যেন মুচকি মুচকি হাসছেন ভদ্রমহিলা। মেমসাহেবকে দেখে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল
আমার। স্কুলে ঢোকার আগে দেখতাম সবাই নমো করছে। আমার নমো করতে ইচ্ছে হতো না। খালি
তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগত। সারদা দেবী, রামকৃষ্ণদেব, স্বামী বিবেকানন্দ-এদের সবাইকে
আগে একটু আধটু চিনতাম। বাড়িতে ঠাকুরের আসনের কাছে একটা অন্য তাক ছিল, যেখানে ওদের
ছবি ছিল। মেয়ে নিবেদিতা ইশকুলে ঢোকার পরে বাবা তাকে অনেক "ছবিতে-জীবনী" কিনে
দিয়েছিল। তাতে ভগিনী নিবেদিতাও ছিলেন। বাকিদের কথা পড়তে তেমন উৎসাহ হতো না। মনে হতো
সবই তো জানি। আসলে ছোট থেকে আমার মেমসাহেব ভাল লাগে। শুধুমাত্র মেম হবার কারণেই
কিনা জানি না সিস্টারকে খুব ভাল লেগে গেল। আমি স্নো হোয়াইট হতে পারিনি কোনওদিন,
জল্লাদ হয়েছিলাম। সিস্টার আমার স্নো হোয়াইট ছিলেন। আমি দয়ালু জল্লাদ ছিলাম, স্নো
হোয়াইটকে না মেরে জঙ্গলে রেখে এসেছিলাম। সিস্টার তাই আমায় খুব ভালবাসতেন।

তারপর ‘নিবেদিতার মেয়ে’ হয়ে হাসিকান্নায় কেটে গেল একটা বছর। ক্লাস টু তে উঠতে না উঠতেই
একজন খুব লম্বা, ফর্সা, বয়স্কা দিদি বড়বাড়ি থেকে এসে একদিন আমাদের ছোটবাড়ির ক্লাসঘরে
ঢুকলেন। নাম জানলাম, দীপ্তিদি। সবসময় হাসেন, সিস্টারও যেমন হাসেন ছবিতে। আমাকে আর সায়নী
সেনগুপ্তকে ডেকে কবিতা বলতে বলা হল। ততদিনে আমি একটু কবিতা-একটু গান এইসব পারি বলে
জানে অনেকে। কিছুক্ষণ বাদে আমাদের ডেকে বলা হল- সামনের কয়েকমাস আমরা যেন চুল না
কাটি। ততদিনে আমার চুল কাঁধ ছাপিয়ে গেছে, দুটো লম্বা ঝুঁটি হয়। সেদিন বিকেল থেকে
শুরু হল আমাদের নিত্য যাতায়াত, বড় বাড়িতে। ঠাকুর দালানে একদিকে বুদ্ধদেব, একদিকে
শ্রীশ্রী সারদা মায়ের সামনে শুরু হল আমাদের মহড়া। সেন্টিনারি উপলক্ষে নাটক হবে ‘নিবেদিতা’। আমি আর সায়নী সেনগুপ্ত সেখানে নিবেদিতার ছাত্রীর
ভূমিকায়। আমরা ছিলাম ছাত্রীদলের দুই কনিষ্ঠতম সদস্য। আমরা পাকা পাকা কথা বলতাম,
দুষ্টুমি করতাম বলে বিনুনি বাঁধা শাড়ি পরা দিদিরা আমাদের নিয়ে হাসি মজা করত। কেউ
কেউ আমাকে ‘ধানী লঙ্কা’ ও বলত।
পরে জেনেছিলাম একে ‘ক্রাশ’ বলে। তখন হয়েছিল সেরকম অবস্থা। আমার তখন ৭ বছর বয়স। প্রমাদি
নিবেদিতা সেজেছিল। তখন ও বোধহয় ক্লাস এইট কিংবা নাইনে পড়ত। অভিনয় করব কি, হাঁ করে
তাকিয়ে থাকতাম। সামনে আবার জ্যান্ত স্নো হোয়াইট। নাটকে আমার ডায়লগগুলো ছিল যথেষ্ট
পাকা-পাকা। একটা দৃশ্য এরকম ছিল, সিস্টার মেয়েদেরকে নিয়ে কলকাতার জাদুঘর দেখাতে
নিয়ে গেছেন, সেখানে আমার চোখ বড় করে, কোমরে হাত দিয়ে, নাকে নথ নাড়িয়ে কি একটা
ডায়লগ দেবার ছিল। মনে আছে গিরীশ মঞ্চে অনেক হাততালি পড়েছিল। উদ্বোধন কার্যালয় থেকে
বাবার কিনে দেওয়া ভগিনী নিবেদিতার জীবনীতে যে ছোট ছোট সুন্দর ঘটনার কথাগুলো
পড়েছিলাম তার প্রায় অনেককিছুই নাটকে ছিল। সবচেয়ে ভাল লাগত সেই সিনটা, যেখানে আমরা
সবাই মঞ্চে বসে আছি মাটিতে বেঞ্চির সামনে, নিবেদিতারূপী প্রমাদি আমাদের হাতে হাতে
শালপাতার ঠোঙায় শাঁকালু, বাতাসা, পেয়ারা, পেঁড়া-এইসব দিচ্ছে। আরেকটা সিনে ছিল হাতে-চানাচুর কিসমিস এইসব
দেওয়া হচ্ছে। রিহার্সালের সময় মিছিমিছি ভান করতাম খাওয়ার। মঞ্চের রিয়ালিজমে সেই সব
খাদ্যবস্তু হাতে পেয়ে খুব সুবিধা হয়েছিল অভিনয় করতে। মেয়েদের দলে বিধবা ছাত্রীর
ভূমিকায় ছিল মেঘলাদি, আমরা সবাই লাল, হলুদ, নীল ডুরে শাড়ি, মাথায় রঙচঙে ফিতে দিয়ে
বেড়াবিনুনী বাঁধা, মুখে মেক-আপ অনেক। মেঘলাদি সাদা থান পরত। কিন্তু নাটকের একদম
লাস্ট সিনে যখন সিস্টার দার্জিলিং চলে যাচ্ছেন, তখন আমাদের কোরাসে গাওয়া একটা গান
ছিল- কয়েকটা লাইন শুধু মনে আছে তার, “আগে চল, আগে চল, দলে দলে” আর “শারদরাতি বিমল ভাতি ফুটেছে কেমন
জোছনা”। মেঘলাদি সেই গানে
স্টেজের এক কোণে গিয়ে চোখের জল মুছত, আর নিবেদিতারূপী প্রমাদি তাকে জড়িয়ে ধরে
সান্ত্বনা দিত। আমরাও মুখ চাপা দিয়ে কাঁদবার ভান করতাম। মেঘলাদি স্টেজ রিহার্সালে
বুদ্ধি দিয়েছিল, চানাচুরের গুঁড়ো নুন চোখের পাতার তলায় দিলে, জল আনতে সুবিধা হবে।
কোনও লাভ হয়নি। প্রথম দুটো গিরীশ মঞ্চের শোতে কোনও জল বেরোয়নি। শেষের দিন, বোধহয়
নাটক শেষ হওয়ার দুঃখেই কেঁদে ভাসিয়েছিলাম আমরা সবাই শেষ দৃশ্যে। ফাইনাল কার্টেনের
পরেও আমরা সবাই প্রমাদিকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিলাম।
গরমের ছুটি পড়ে গেল। আমার বাবা তখন দার্জিলিং-এ কর্মরত। বাবার কাছে ছুটিতে
বেড়াতে গিয়ে বায়না ধরলাম সিস্টারের বাড়ি, সমাধি-এইসব দেখব। বাবা বলেছিল, জায়গাগুলো
ভাল না। চোর-গুণ্ডা-মাতালরা ধারে কাছে ঘোরাফেরা করে। রায়ভিলার বাড়িটা, লেবং কার্ট
রোডের ওপর। একদিন জিপে করে নিয়ে গিয়েছিল বাবা। দার্জিলিং টয় ট্রেন স্টেশনের কাছে,
কুয়াশাঘেরা স্যাঁতস্যাঁতে জুনমাসের বিকেলে দূর থেকে অনেক গাছপালার মধ্যে দেখতে
পেয়েছিলাম একটা সৌধ মত কী যেন। সবটা মনে নেই, আবছা-আবছা। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। শারদরাত্রি
ছিল না অবশ্য। তবে জোছনা নিশ্চয়ই ফুটেছিল কোথাও। মেমসাহেব, তবুও কবর দেয়নি
সিস্টারকে। দাহ করে পাওয়া ছাই সৌধের তলায়। আমার স্নো হোয়াইটকে গাছপালার দেশে,
পাহাড়ের দেশে, কুয়াশার দেশে ঘুমাতে দেখে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম মনে মনে।
“আগে চল, আগে চল, দলে দলে...”
অরিত্রী চক্রবর্তী [২০০৭]
অরিত্রী! তোর লেখাটা যে কী পছন্দ হয়েছে!
ReplyDeleteHne hne hne :D
Deleteজমজমাট :D ... মন ভাল করে দেওয়া
ReplyDeleteyo yo :P :*
Deleteki sundor je laglo lekhata bole bojhate parbona re. :)
ReplyDeleteThank you re :D
DeleteOffice bose kaaj er phake lekhata pore satti satti mon ta bhalo hoe gelo... lekhar sathe sathe nijeo jeno Darjeeling pouche gelam Sister er kache :-)
ReplyDeleteAmi last darjeeling gechi 99 shale. Tarpor baba bodli hoe jay. Oi samay ta abdhi ekdum nijhum poro barir r moton chhilo roy villa. Chowk bajar er kachhei. Chor gunda anti-social barita dokhol niyechilo. Baire theke ekta paharer gaye dhap kete toiri kora bhuter bari lagto puro. Somadhi ta tulonay khanikta porishkar joddur mone pore. khub i abchha smriti amar. Bakita abochetan ☺☺☺
DeleteMon bhalo kore deoya ekta lekha likhechhis re Aritri.... :)
ReplyDeleteThank you. Bhalo theko di ☺
DeleteKhub mishti lekha. .annual function ar centenary er din gulo mone pore galo.
ReplyDeleteAmaro. ☺
Delete"শারদরাত্রি ছিল না অবশ্য। তবে জোছনা নিশ্চয়ই ফুটেছিল কোথাও। মেমসাহেব, তবুও কবর দেয়নি সিস্টারকে। দাহ করে পাওয়া ছাই সৌধের তলায়। আমার স্নো হোয়াইটকে গাছপালার দেশে, পাহাড়ের দেশে, কুয়াশার দেশে ঘুমাতে দেখে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম মনে মনে।"
ReplyDeleteকাঁটা দিয়ে উঠল শরীর, অসাধারণ
1999 shaler por ar darjeeling jaini. Opore ekta comment e likhlam dekho.
DeleteKi pranobonto lekha. Khub bhalo laglo.
ReplyDeleteTor lekhata jano Kato jibonto... Chokh er samne jno sob sposhto dekhte pachi.. ��
ReplyDeleteশুধু মন নয়,,সমস্ত চেতনায় ছেয়ে থাকা অনুভূতি ...প্রচন্ড গরমে একঝলক দার্জিলিঙের হাওয়ার মতোই তরতাজা আর নতুন অনেক সুখস্মৃতি মনে করিয়ে দিলো
ReplyDeleteKhub sundor.. natok ta sposhto mone ache..r proma di r nivedita sotyi asadharon hoyechilo..ami meghla r batch er, 1997-98 ami class six..ki je darun ketechilo oi duto bochor!
ReplyDelete