আজও সেই সার্ধ শতবর্ষীয়া


অনেকটাই লিখে ফেলেছিলাম। প্রায় দু পাতা। আর একটু ছিল বাকি। জোর করে তা ছিনিয়ে নিয়ে মেয়ে বলল, এ কী! এসব ইতিহাস টিতিহাস কে লিখতে বলেছে! তুমি অভিভাবক হিসেবে আমাদের স্কুল নিয়ে লেখআমি বললাম, সে কী রে, ১৮৯৫-এ লন্ডনে বিবেকানন্দের বেদান্ত নিয়ে বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে ১৮৯৮-এ মার্গারেট এলিজাবেথ নোবলের কলকাতায় আসা, স্বামীজির শিষ্যা নিবেদিতা হয়ে ওঠা, নারীশিক্ষায় বোসপাড়া লেনে মেয়েদের স্কুল গড়া, ১৮৯৯-এ কলকাতায় প্লেগ মহামারিতে রোগীর সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়া- এসব লিখব না! তারপর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিবেদিতার সখ্য, স্বামীজির দ্বিতীয় বিদেশ সফরের পর কলকাতায় ফেরায় চায়ের আসর ডেকে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা, জগদীশচন্দ্র বসু, লেডি অবলা বসুর সঙ্গে নিবেদিতার বন্ধুত্ব- লিখব না এসব! লিখব না অবলা বসুর নারী শিক্ষা সমিতিতে নিবেদিতার সহায়তা, নিবেদিতার স্কুলের তহবিলে অবলা বসুর ১০ লাখ টাকা দানের কথা লেখা যাবে না? লিখব না মাঝে মাঝেই উইক এন্ডে জগদীশচন্দ্র বসু, লেডি অবলা বসুর সঙ্গে শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিবেদিতার বৈঠক, আলোচনার কথা! নিজে আয়ারল্যান্ডের, রবি ঠাকুরের 'গোরা'ও আইরিশ, সে উপন্যাস পড়ে, কবির সঙ্গে নিবেদিতার কত আলোচনা, এরপর স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের সহায়তা দান- লিখব না সে সব কথা? মেয়ে বলল, না, না, এসব লেখার বিস্তর লোক আছে। তুমি অভিভাবক হিসেবে লেখ

মাতৃআজ্ঞা শিরোধার্য। আমার মেয়ের জন্মের পর থেকে ওকে মা-হারা আমি মা বলেই ডাকি,ও জন্মাতেই মনে করে এসেছি স্বর্গগতা মা ফিরে এসেছে আমাদের কোলে, এখন এই তরুণী বয়সে দেখতেও সে আমার মায়ের মতো, তাই আমি এত মা, মা রে করি, তাই লিখছি ও যেমন চায়, তেমনটি। কিন্তু অভিভাবক! না, না, অমন জাঁদরেল পদে আমি কক্ষনও উঠিনি। দাপটের ক্ষীণমাত্র আমার নেই। মেয়ের কাছে আমি বাচ্চাটি, কত ধমকধামক সহ্য করি
           
তাহলে শুরু থেকেই শুরু করি। তখন শ্রীরামপুরের নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বরানগরের ভাড়া বাসায় এসেছি। আমার মেয়ে শ্রীরামপুরেই বছর আড়াই বয়সেই আমার এক বন্ধুপত্নীর কিন্ডারগার্টেনে আবদার করে বসে থাকত। অক্ষরজ্ঞান, বাক্যগঠন শিখতেই সে তার বাবার কবিতার বই "জলপাই কাঠের এসরাজ" তরতরিয়ে পড়তে থাকে। বরানগরে এসেও মুকুল স্কুলে আন্ডারএজে এক বছরে পড়ে ফেলে। তখন আমি একটি সংবাদপত্র থেকে আরেকটি সংবাদপত্রে যোগ দিয়েছি। বেতন যা পাই অর্ধেকই চলে যায় বাড়ি ভাড়ায়। খুব চিন্তায় পড়েছিলাম, কলকাতার স্কুলগুলিতে তখন থেকে ব্যবসার ভূত ঘাড়ে বসতে শুরু করেছে। তাই মেয়েকে কোথায় কোন স্কুলে ভর্তি করতে পারব, খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। তা আমার মেয়ে রামকৃষ্ণ সারদা মিশন সিস্টার নিবেদিতা স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির পরীক্ষায় উতরে আমাদের উদ্বেগ কাটিয়ে দিল। সে পরীক্ষা উৎরনোর পর ইন্টারভিউ, মেয়ের সঙ্গে তার মা বাবাকেও যেতে হবে। আমি কবিতা লিখিয়ে উসকোখুসকো মানুষ, সাধু সন্ন্যাসীদের খুব ভয় পাই। তার ওপর ভগিনী নিবেদিতার গড়া এই স্কুলে কতৃপক্ষ স্থানীয় দিদিমণিরা সন্ন্যাসিনী। বুক দুর দুর করতে লাগল আমার। তবু যেতে তো হল। ও মা গিয়ে দেখি, কী মধুর ব্যবহার তাঁদের, কী সুমিষ্ট কথাবার্তা, আমাদের মত মানুষজনের প্রতি কত দরদ তাঁদের। তাঁদের প্রশ্নে আমার মেয়ে টক টক করে বলল, বাবাকেই বেশি ভালোবাসে সে। ফের প্রশ্ন সন্ন্যাসিনীদের, মা-কে নয় কেন? মেয়ে জবাব দিল, মা বকে, মা মারে। আমি তখন আহ্লাদে আটখানা।

ছোটবাড়িতে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে গেল আমাদের মেয়ে, মন্দাক্রান্তা। স্কুলে গিয়ে জুতো খুলে, ফেরার সময় নিজে ফিতে বেঁধে জুতো পরে নিতে হত, ওই শিশুদের স্বাবলম্বী করার প্রাথমিক পাঠ- আমার ভারী ভাল লেগেছিল। তারপর দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণী... একবার গরমের ছুটিতে ওদের একটি গ্রাম দেখে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন শিক্ষিকা, আমি বালি হল্ট থেকে ট্রেকারে চড়িয়ে মন্দাক্রান্তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের শ্রীরামপুরের পশ্চিমের বড়া কমলপুর গ্রামগুলিতে। গ্রাম দেখে তো খুশিতে সে রচনায় প্রথম বাক্যটিই লিখেছিল, কলকাতার চেয়ে গ্রাম অনেক সুন্দর। আর একবার গঙ্গা ছাড়া অন্য একটি নদী দেখতে বলায় ওকে হংসেশ্বরী মন্দিরের লাগোয়া সরস্বতী নদী দেখিয়ে এনেছিলাম। নিচু ক্লাসে ভূগোলের খাতায় উৎপাদিত ফসল হিসেবে জোয়ার, বাজরা, যব, মকাইয়ের দানা সেঁটে দিতে বড় বাজারের দোকান খুঁজে খুঁজে সেসব এনেছিলাম। একবার স্বাধীনতা যোদ্ধা বিপ্লবীদের ছবি চাই, কলেজ স্ট্রিট থেকে আনলাম। মেয়ে বলল, রঙিন ছবি চলবে না। ফের গেলাম কলেজ স্ট্রিটে, দোকানদার বললেন, এক কাজ করুন, জেরক্স করলেই তো ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট। তা-ই করলাম। তবে কিনা, মেয়ের দেখভাল মেয়ের মা-ই করেছেন। আর শিক্ষিকারা মানুষ করেছেন, আমি করেছি যত সব আমুদে কাজ।


 ছোট বাড়ির উল্টো দিকে বড়ো বাড়ি, নিবেদিতা স্কুলের মূল ভবন, এই ভবনের নকশা নন্দলাল বসুর করা। আমার মেয়ে ছোট বাড়িতে প্রাথমিক চারটি শ্রেণীতে যখন পড়েছে, আর বড় বাড়িতে মাধ্যমিক শ্রেণীগুলিতে, যে কয়েকবার গিয়েছি, বড়বাড়িতে, মানে মূল ভবনের দেওয়ালে হাত বুলিয়েছি, ইতিহাসের ধুলো সে দেওয়ালে। ভগিনী নিবেদিতাসহ কত মনীষীর স্মৃতিধন্য এই ভবন। বোসপাড়া লেনে নিবেদিতার স্কুলে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কবি চেয়েছিলেন নিবেদিতাকে তাঁর কন্যার গৃহশিক্ষিকা নিযুক্ত করতে, নারী শিক্ষার দেদার কাজ, দেশের কাজ, দশের কাজে সময়াভাবে সিস্টার নিবেদিতা রাজি হননি। বড়বাড়িতে আমার মেয়ে যখন ক্লাস সিক্স, অভিভাবকদের একদিন ডেকেছিলেন ক্লাস টিচার মালাদি। কথা হল এমন, যেন কতকালের চেনা। 

আজও স্কুল শুরুর সময়ে সকালে, বা বিকেলে স্কুল ছুটির সময়টায় বাসে, সড়কে নিবেদিতা স্কুলের ব্যাজ আঁটা স্কুলড্রেসে ছাত্রীদের দেখলে মনে হয় সার্ধ শতবর্ষীয়া নিবেদিতা যেন বর্ষে বর্ষে তাঁর কোঁচর থেকে দুহাত ভরা ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছেন ভূভারতে সুবাস ছড়াতে। বিকশিত পুষ্পসকলের দীপ্তিতে, বর্ণচ্ছটায় ভারত-গর্ব ছড়িয়ে পড়ছে।








মৃদুল দাশগুপ্ত
_________________________________________________________________________ 


লেখক পরিচিতিঃ 
মৃদুল আধুনিক বাংলা ভাষার এক অত্যন্ত প্রতিভাবান ও গুরুত্বপূর্ণ কবিনিজের পরিচয় যদিও দেন কবিতাপ্রয়াসী বলে। পেশায় সাংবাদিক।

3 comments: