আয়ারল্যান্ড যাওয়ার ইচ্ছে ছিল বহুদিনের, কারণ আইরিশ সংস্কৃতির হাওয়ার ঝাপটা নিজের চোখেমুখে মেখে নেওয়ার বাসনা এড়ানো সত্যিই দুষ্কর। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন যাওয়ার সুযোগটা এসে গেল এবছর জুন মাসে কিছুটা কাকতালীয়ভাবে। ডাবলিন থেকে বেলফাস্ত, গ্লাসগো হয়ে এডিনবরা যাবার দশদিনের একটা ছোট প্ল্যান বানালাম, যা আমার একান্ত নিজস্ব। কর্মব্যস্তময় জীবনের দিনগত পাপক্ষয়ের মাঝে এক টুকরো মুক্তির অবকাশ। প্ল্যান বানানোর পর মনে হল এত জায়গায় যাব আর সিস্টারের জন্মস্থান ডানগানন শহরে যাব না সেটা হয় নাকি? ডাবলিন থেকে ডানগানন মাত্র একশ মাইল। তাই ডাবলিন থেকে ডানগানন যাওয়ার একদিনের একটা অবসরের প্ল্যান বের করে নিলাম ওই ছোট ব্যস্ততাটুকুর মধ্যেই। তবে ডানগানন যেহেতু খুব পরিচিত কোনও পর্যটন শহর নয়, তাই কানাডা থেকে কোনও টিকিট বা বুকিং করা সম্ভব হল না।
১৮ই জুন রবিবার ডাবলিন পৌঁছলাম। ইউরোপ ভ্রমণে হস্টেলে থাকার একটা আলাদা স্বাধীনতামিশ্রিত সুখানুভূতি আছে। তাই ডাবলিনেও ইয়ুথ হস্টেল বুক করেছিলাম। সকাল দশটায় ডাবলিন যখন পৌঁছলাম তখন ডাবলিনের দোকানপাট সব বন্ধ, রাস্তাঘাট শুনশান। আসলে চার্চের প্রার্থনা সময় উত্তীর্ণ করে ডাবলিন জেগে ওঠে দুপুর বারোটার পর। হস্টেলের রিসেপশানে কর্মরত ছেলেটি আফ্রিকান-কানাডিয়ান। একটু ভাব জমে উঠতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম ডানগানন যাওয়ার টিকিট কোথায় পাব। ছেলেটি মনে হল না খুব পরিচিত ডানগানন নামক কোনও শহর সম্বন্ধে। অনেকবার জিজ্ঞেস করল শহরের নামটা। শেষে আমি ছোট একটা কাগজে লিখে ওকে দেখালাম: “Dungannon”. ও হেসে বলল, Oh,Doh-ne-gul? I don’t think you can make it in one day but please check it out in the tourist office.” টুরিস্ট অফিসের লোকজন ম্যাপে ডানগানন চিহ্নিত করল সঠিক, কিন্তু উচ্চারণ করল : “Duh-neh-gon”. উচ্চারণের এই রকমফেরটা বেশ উপভোগ্য ছিল আমার কাছে কারণ ছোট থেকে স্কুলে সিস্টারের জন্মস্থান ডানগানন আমাদের ব্রিটিশ উচ্চারণ “Dan-ga-non” শেখানো হয়েছিল আর আমিও ওই উচ্চারণে অভ্যস্ত। যাইহোক, বাসস্টপে পৌঁছে দেখলাম রবিবার বলে অধিকাংশ টিকিট কাউন্টার বন্ধ। তাই যে বাসটা সরাসরি ডানগানন যায় (বাস নম্বর এক্স ফোর) সেটার টিকিট পাওয়া গেল না। তাই যে রুটটার টিকিট অবশেষে পেলাম, সেটায় যাত্রার সময় অনেকটাই বেড়ে গেল কারণ ডাবলিন থেকে বালিগাওউলি (Ballygawley) তে নেমে বাস চেঞ্জ করে লোকাল বাসে চেপে ডানগানন যেতে হবে। সময় লাগবে পৌনে তিন ঘণ্টার জায়গায় প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা।
 |
ডানগাননের রাস্তাঘাট |
২০শে জুন মঙ্গলবার ভোরবেলা বাস ধরলাম ডাবলিনের মেন বাসস্টপ থেকে ডানগাননের উদ্দেশ্যে। যাত্রী মাত্র আমি আর আরেকজন আইরিশ মহিলা। মহিলা স্কুলটিচার তাই জানবার আগ্রহ ও কৌতূহল প্রবল আর আমি ইন্ডিয়ান শুনে আগ্রহভরে ইন্ডিয়ার অনেক গল্প শুনলেন। এর অবশ্য আরেকটা কারণ আমার মনে হয়েছিল তখন, যে কারণে যে কোনও ইন্ডিয়ানের গর্ব হবে, সেটা হল বর্তমানে আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লিও ভরদকার ভারতীয় উত্তরসূরী। নির্দিষ্ট সময়ে ড্রাইভার বালিগাওউলিতে নামিয়ে দেবার পর দেখলাম এলাকাটি প্রায় জনমানবশূন্য। কিছু দূরে ছড়ানো ছিটানো কিছু ঘরবাড়ি। মঙ্গলবার সকাল নটায় একজনও লোক নেই রাস্তায়। এবার বেশ বিপদ। কারণ জানি না কোন লোকাল বাসে করে যাব ডানগানন আর জিজ্ঞেস করার জন্য একটিও লোক নেই বা দোকানপাটও দেখা যাচ্ছিল না কাছাকাছি। বেশিদূর এগোতেও সাহস হচ্ছিল না পাছে বাস মিস করি, কারণ ঘণ্টায় মাত্র একটা করে বাস। অগত্যা আসন্ন বাস ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে চুপচাপ বসে আছি বাসস্টপে, এমন সময় একটু পরে বয়স্ক এক ভদ্রলোকের দেখা পেলাম। ভদ্রলোক বেশ মৃদুমন্থর গতিতে বাসস্টপে এসে বসলেন এবং ধীরে ধীরে সৌজন্যমূলক বাক্যালাপ শুরু হল আমাদের মধ্যে। আমি কানাডা থেকে আসছি শুনে উনি বললেন যে, “I always wanted to go outside Ireland but I don’t have any passport. I have never been outside Ireland.” ভদ্রলোকের চেহারা বা পোশাকআশাক দেখে আমার মনে হল না যে কোন সামাজিক বা অর্থনৈতিক কারণ থাকতে পারে পাসপোর্ট না থাকার। হয়তো আমার বিস্ময় বুঝে নিজেই আবার বললেন যে, “Not everyone is lucky to see the world. I am here all my life my dear” আর বলেই অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। নিস্তব্ধতা ভেঙে আমিই শুরু করলাম বাক্যালাপ ডানগানন সম্পর্কে। কেন যাচ্ছি, ভগিনী নিবেদিতা ওরফে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল কে, ডানগাননে মার্গারেটের জন্মস্থান ইত্যাদি ইত্যাদি। দেখলাম উনি মার্গারেট এলিজাবেথ নোবলের নামের সাথে পরিচিত। অতি স্বল্পভাষী মানুষটি আমায় উপযাচক হয়ে বলেও দিলেন ডানগাননের বাসস্টপ থেকে ভিজিটর সেন্টার কী করে যাব। তবে ওঁর মুখে ডানগাননের উচ্চারণটা ছিল: “Duh-neh-gon-ya”। শেষের ঐ “ইয়া” টানটা আসলে লোকজ উচ্চারণের অঙ্গ। বাসে ওঠার আগে ওঁর নাম আমার জানা হয়নি তবে আমার ইচ্ছাতে ওঁর সঙ্গে একটা ছবি আমি তুলেছিলাম যাতে ওঁর মুখটা আমার জীবনের ভিড়ে হারিয়ে না যায়। এই পরম পাওয়ার মুহূর্তটাকে মুঠোফোনে বন্দী করার পর নিজের মনের কোথাও একটা সুখানুভূতি ছিল।
 |
বালিগাওউলি বাসস্টপে |
ভিজিটর সেন্টার থেকে সিস্টারের বাড়ির অবস্থানটা জেনে নিয়েছিলাম। ডানগানন শহরের রাস্তায় লোকজন বেশ কম, কাজের দিনের সকালেও ডাউনটাউনের মেন স্কোয়ারে বসে থাকলে মনে হবে কোনও ছুটির দিনের সকাল। ছোট্ট শহর তাই মেন স্কোয়ারের থেকে কিছুদূর গিয়ে বাঁদিকে মোড় নিলে সিস্টারের বাড়ি পাওয়ার কথা। কিন্তু ঠিক বাড়ির সামনে এসে একটা ঝটকা খেলাম! এ কী! কিছুই তো নেই বালি সিমেন্টের ভগ্নস্তুপ ছাড়া। এবছর যেখানে দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ও কেন্দ্রে ভগিনীর সার্ধশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে সেখানে নিবেদিতার জন্মভিটে ভেঙে প্রসারিত হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দোকান। যে ভিটেতে ভগিনীর জন্ম, যে বাড়িটিতে লাগানো আছে “ব্লু প্লাক”, সেটি কি হেরিটেজ ঘোষণার দাবী রাখে না? আর কিছুই দেখিনি তারপর ডানগাননে, সোজা বাসস্টপে এসে পরবর্তী বাসের নতুন টিকিট কাটলাম।
 |
চোখ ঝাপসা করা সিস্টারের বাড়ির সেই ভগ্নস্তূপ |
বাসে যখন উঠলাম তখন চোখ ঝাপসা। বারবার মনে হচ্ছিল, না এলেই কি ভালো হতো? তাই এই প্রসঙ্গটাও লিখতে চাইনি অনেকদিন, পাছে অনেকের কষ্ট হয়। কিন্তু দেখলাম গত ২৩শে অক্টোবর কলকাতায় নিবেদিতার ১৬ নং বোসপাড়া লেনের বাড়ির উদ্বোধন হল মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে। আনন্দবাজার সূত্রের খবর অনুযায়ী আগামী ১২ই নভেম্বর মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, রামকৃষ্ণ মঠ এবং মিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট উপস্থিত থাকবেন উইম্বলডনের নিবেদিতার আরেকটি বাসস্থানের উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে-২১ হাই স্ট্রীটে। হেরিটেজ ঘোষণার সম্মানার্থে উইম্বলডনের বাড়িতে আবার লাগানো হবে “ব্লু প্লাক” ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদনে। তাই লিখেই ফেললাম সিস্টারের এই আদিবাড়ির ঘটনাটা আমার ডানগাননের ডায়েরি থেকে।
পর্ণালী ধর চৌধুরী [১৯৯৭]
পর্ণালীদির চোখ দিয়ে ডানগানন ঘোরা হয়ে গেল।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো, পৰ্ণালী। Dungannon-এর Irish উচ্চারণ টা শুনতে ইচ্ছে করছে খুব। খুঁজলাম YouTube ইত্যাদিতে খানিকক্ষণ, পেলাম না :(
ReplyDeleteTupur tui porli? তোর ভালো লেগেছে মানে আমি কিছুটা হলেও তোর মতো লিখতে সফল হয়েছি। Dungannon er pronunciation ta sotyi obhinobo experience.
Deleteঅনেক ধন্যবাদ ঋতুপর্ণা
ReplyDelete