অর্কুটে
ছিলাম সেসময়। হঠাৎই একদিন এক ব্যাচমেটের সঙ্গে দেখা। আর তার সূত্রে সরস্বতী পুজোয় আমার স্কুলে
যাওয়া, এক দশক পর। তার আগে যদিও হ্যালোজেনমাখা নিবেদিতা লেন দিয়ে অলক্ষ্যে হেঁটে এসেছি
কয়েকবার...
বোরোলিন হাউসের দেওয়ালের গ্রাফিতির সামনে বেবাক দাঁড়িয়ে থেকেছি একা। থিয়েটারের শো করতে যতবার গিরীশ মঞ্চে ঢুকেছি... সাজঘরে, সিঁড়িতে, হলের ভেতর, মঞ্চে সর্বত্র ইশকুলবেলার সুঘ্রাণ এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, লন্ডভন্ড করে দিয়েছে সব। স্কুলের মেন গেটের সামনে দিয়ে ‘কিছু না’ ভাব করে হেঁটে গিয়েছি আড়চোখে দেখতে দেখতে... ছবির ভিতর থেকে সিস্টার, সেই পুরনো দিনগুলোর মতোই, একইভাবে তাকিয়ে হেসেছেন মৃদু। ঘাড় উঁচু করে দেখেছি বাইরে থেকে, ওই আমাদের সেভেন-এ আর সিক্স-এ-র ঘর। বাঁদিকে ওই তো ম্যাপঘর, টিচার্স রুম। আর একটু এগোলে গ্যারেজের কাছটায় ক্যান্টিন, জুতোর র্যাক... কোলাপসিব্ল গেটের মধ্যে দিয়ে ঈষৎ উঁকিঝুঁকি দিয়ে যাবে আমার কৈশোর...। অনেক বছর পর অমৃতাকে খুঁজে পেলাম যখন, বলেছিল, “স্কুলের সময়টাকে আমি মনের মধ্যে জমাট করে রেখে দিয়েছি। জমাট দইয়ের মতো। এতটুকু টোল না খায়”। অমৃতা আমার স্কুলজীবনের ‘বেস্ট-ফ্রেন্ড’। আমাদের অনেকের ভেতরেই স্কুল ঠিক ওভাবেই থেকে গিয়েছিল। আলগোছে, অথবা সতর্কতায়। ছুঁয়ে, নেড়ে, ঘেঁটে তাকে রোজকার জীবনের মধ্যে মিশিয়ে, জলচল করে দিতে ইচ্ছে করেনি। অথচ সব ওলটপালট হয়ে গেল সেদিন সরস্বতী পুজোয়, স্কুলের উঠোনে পা রাখবার পর।
বোরোলিন হাউসের দেওয়ালের গ্রাফিতির সামনে বেবাক দাঁড়িয়ে থেকেছি একা। থিয়েটারের শো করতে যতবার গিরীশ মঞ্চে ঢুকেছি... সাজঘরে, সিঁড়িতে, হলের ভেতর, মঞ্চে সর্বত্র ইশকুলবেলার সুঘ্রাণ এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, লন্ডভন্ড করে দিয়েছে সব। স্কুলের মেন গেটের সামনে দিয়ে ‘কিছু না’ ভাব করে হেঁটে গিয়েছি আড়চোখে দেখতে দেখতে... ছবির ভিতর থেকে সিস্টার, সেই পুরনো দিনগুলোর মতোই, একইভাবে তাকিয়ে হেসেছেন মৃদু। ঘাড় উঁচু করে দেখেছি বাইরে থেকে, ওই আমাদের সেভেন-এ আর সিক্স-এ-র ঘর। বাঁদিকে ওই তো ম্যাপঘর, টিচার্স রুম। আর একটু এগোলে গ্যারেজের কাছটায় ক্যান্টিন, জুতোর র্যাক... কোলাপসিব্ল গেটের মধ্যে দিয়ে ঈষৎ উঁকিঝুঁকি দিয়ে যাবে আমার কৈশোর...। অনেক বছর পর অমৃতাকে খুঁজে পেলাম যখন, বলেছিল, “স্কুলের সময়টাকে আমি মনের মধ্যে জমাট করে রেখে দিয়েছি। জমাট দইয়ের মতো। এতটুকু টোল না খায়”। অমৃতা আমার স্কুলজীবনের ‘বেস্ট-ফ্রেন্ড’। আমাদের অনেকের ভেতরেই স্কুল ঠিক ওভাবেই থেকে গিয়েছিল। আলগোছে, অথবা সতর্কতায়। ছুঁয়ে, নেড়ে, ঘেঁটে তাকে রোজকার জীবনের মধ্যে মিশিয়ে, জলচল করে দিতে ইচ্ছে করেনি। অথচ সব ওলটপালট হয়ে গেল সেদিন সরস্বতী পুজোয়, স্কুলের উঠোনে পা রাখবার পর।
উঠোনের দাগ কাটা খরখরে মেঝে, ঠাকুরদালান আর লাল বারান্দার মোমপালিশ করা
চুঁয়োনো ঠান্ডা, ক্লাসরুমগুলোর বেঞ্চ আর ব্ল্যাকবোর্ড থেকে উঠে আসা কাঠ-চক-শ্লেটপাথরের
মেদুর আঘ্রাণ, জানালার খড়খড়ি, দেওয়ালে চিরপরিচিত ছবির তেলরঙ, গোটা ইশকুলবাড়ি জুড়ে
হলুদ-সবুজ-গেরুয়ার মায়ামিশেল আমার সমস্ত স্মৃতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। ফোর সি
বিল্ডিঙের সিঁড়ি বেয়ে চারতলা থেকে দেখে এলাম দূরের গঙ্গা... ওপরে ছাতে তখন আবাসিক
দিদিদের গেরুয়া বসনগুলো হাওয়ায় দুলছে! কী প্রশান্তি, কী মায়া চারদিক ঘিরে! মনে হল, ঘুমিয়ে পড়ি। কতদিন,
কত বছর এমন নিবিড় করে ঘুম আসেনি চোখে! নীচে তখনও কোলাহল গোটা স্কুল জুড়ে। বাইরে
আলতো বিষন্ন হাঁক দিয়ে যাচ্ছে ফেরিওলা... মাঘের শীতরোদ আলগোছে শুয়ে আছে বারান্দায়... স্কুল থেকে আর বেরনো হল না আমার।
স্পষ্ট দেখলাম সেই সমস্ত শব্দ-বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শ নিয়ে আমার শৈশব, কৈশোর ওই
স্কুলবাড়ির ভেতর দাঁড়িয়ে আছে আজও। যাকে বাদ দিয়ে, খন্ডিত করে আমি কিছুতেই সবটা ‘আমি’ নই। মনে হল বছরের পর বছর
এভাবেই আজীবন ফিরে ফিরে যাব নিজেকে ছুঁতে... পুরনো সময় জমাট বেঁধে বেঁধে আছে যে
গলিতে, যে বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে।
স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম আট বছর বয়সে।
ছেড়ে বেরিয়েছি যখন পনের। আট থেকে পনের, এই সাত বছরে কী এমন জাদু করেছিল নিবেদিতা
স্কুল, যে আজও এই মধ্যবয়সে এসে তাকে ঘিরে এত আবেগ, এত উৎসাহ, এত ছুঁয়ে থাকা? এসবই
কি নস্টালজিয়া শুধু? আত্মপ্রেম? নিজের টোয়েন্টিজ-এ এসে সমস্ত শূন্যতার মধ্যে
বারংবার কেন মনে পড়েছে তাকে? যে স্মৃতিগুলোকে আত্মনির্বাসনে রেখেছি সরিয়ে, যে
চৌকাঠ পেরিয়ে ঢুকতে চাইনি, চোখে চোখ রেখে দাঁড়াতে পারিনি যে টিচার্স রুমের দরজায় এসে...
সেই স্কুল কেন বারবার ফিরে এসেছে চেতনে, অবচেতনে... রাতের অলিন্দ বেয়ে নিঃসাড়ে!
এসে দাঁড়ায়নি শুধু, নীরবে হাত রেখেছে মাথায়। সমস্ত অবিশ্বাস আর নৈরাশ্যের মধ্যে
আত্মজিজ্ঞাসার আলোটুকু, ওমটুকু দিয়ে গেছে নির্ণিমেষ?
এক দশক পেরিয়ে সেদিন স্বরূপাদির সঙ্গে
যখন দেখা, কোনও কথাই আর সরছে না আমার মুখে। যে স্বরূপাদির কাছে বাংলা ভাষা,
মাতৃভাষার ব্যাকরণ শিখেছি... শিখেছি, কীভাবে পাঠ করতে হয় একটা ভাষাকে। যে ছাঁচ
মাথায় রেখে আজ ফরাসির মতো একটা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পড়তে গিয়েও অসুবিধে হচ্ছে না
আর। ‘মুহূর্ত’ বানান ভুল হয়েছে বলে পঞ্চাশবার লিখিয়েছিলেন যে স্বরূপাদি, আমার
বুড়ো বয়সে, ক্লাস নাইনে এসে... যাঁর সঙ্গে রামায়ণ-মহাভারত থেকে সুমন-নচিকেতা অবধি সব
গল্প-আলোচনা-আড্ডা দিয়েছি বসে। যন্ত্রের মতো হেসেছি সেদিন ঘাড় কাত করে; বলেছি ‘হ্যাঁ ভাল আছি, আপনি ভাল’? আসলে ভেতরে ভেতরে তোলপাড়
হয়ে যাচ্ছি তখন। বলতে চাইছি, একেবারেই ভাল নেই দিদি। কী অনিঃশেষ কষ্ট দিয়েছে জীবন এই একটা দশকে।
কেন আমাদের এত যত্ন করে আগলে বড় করলেন আপনারা? কেন একটু বুঝতে দিলেন না এই চৌকাঠের
বাইরের পৃথিবীটার সঙ্গে এই বাড়িটার, এই সাতটা বছরের কণাটুকু মিল নেই? এবাড়িটা তো
কথায় নয়, সত্যি জীবনে আমাদের ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ ছিল।
ইশকুলবেলা
যখন
ভর্তি হই, তার আগে নামটা পর্যন্ত জানতাম না স্কুলের, যে স্কুল আগামী সমস্ত
বছর ধরে ছায়া ফেলে থাকবে পাশে-পাশে... যাকে সঙ্গে করে বয়ে চলা বা ঝেড়ে মুছে ফেলতে
চাওয়া, যাইই হোক না কেন, অস্বীকার করা যাবে না একটি মুহূর্ত! নানান অনুষঙ্গে,
নানান রূপে যে স্কুল সারাজীবন মননে-চিন্তনে-যাপনে নিজের দাগ রেখে যাবে, যার যার
কাছে যার যার মতো!
মায়ের হাত ধরে ভর্তির পরীক্ষায় এলাম। রচনায় এসেছিল “দুর্গাপুজোর চারদিন”। ওরাল টেস্টে প্রথম জানলাম স্কেল দিয়ে শুধু লাইনই টানে না, স্কেল দিয়ে কোনও
জিনিস মাপাও যায়! কী জানি কিসব উত্তর দিয়েছিলাম, বয়সে এক বছর ছোট হওয়ায় দোনোমোনো
করেও সেই সেশনে শেষমেশ ভর্তি নিয়েই নিলেন জপপ্রাণা মাতাজি, ছোটবাড়ি মানে
প্রাইমারির বড়দি। তার আগে ক্লাস টু অবধি একটা ছোট্ট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তাম।
প্রথম ছ’মাস নিজেকে মানিয়ে নিতেই
কেটে গেল। সবাই শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। প্রথমদিন ক্লাসে এসে ‘গুড মর্নিং’ বলায় আমাকে নিয়ে হাসাহাসি
হয়েছে। ‘মে আই গো টু টয়লেট’ না বলে এখানে বলতে হয়, ‘দিদি ছোটবাইরে যাব?’ এক ক্লাস উঁচু মেয়েদেরও
দিদি বলতে হয়। অনেকেই পরস্পরকে ‘অ্যাই মেয়ে’ বলে ডাকে! ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বললে মুখ ভ্যাটকায়! অঙ্ক ক্লাসে সমস্ত রাশি বাংলা থেকে আগে
ইংলিশে লিখে নিয়ে অঙ্ক কষি, তারপর উত্তর বের করে আবার ইংলিশ থেকে বাংলায় লিখি। নামতা মুখস্থ করতে গিয়ে ‘টেবলস’ বলে ফেলি। প্রিপেটরি
ক্লাসের ইংলিশ টেক্সটবই পাঠ্য হিসেবে পড়ছি ক্লাস থ্রিতে এসে। শুধু ট্রান্সলেশনের ক্লাসে মজা। আর মজা বাংলা
ক্লাসে! জীবনে প্রথম সারাংশ লিখছি... নামকরণের সার্থকতা লিখছি! ইতিহাস-ভূগোল-স্বাস্থ্য
পড়ছি! হাফ-ইয়ার্লিতে চুয়াল্লিশ র্যাংক হল সত্তর জন মেয়ের মধ্যে। এর আগে অবধি কখনও
দ্বিতীয় হইনি। বুঝলাম অকূল দরিয়ায় এসে পড়েছি। বড়দি হতাশ হলেন। বাড়িতে প্রবল
ধিক্কার জুটল! অধঃপতন হয়েছে বলে দু’-একজন গৃহশিক্ষক রাখার চেষ্টা হল। তাঁরা কেউই নিবেদিতা
স্কুলের সমান মানের পড়াশোনা শিখিয়ে উঠতে পারলেন না।
ক্লাস ফোরে উঠে পালে কিঞ্চিৎ হাওয়া পেলাম... পায়ের তলায় জমি। ক্লাসটিচার ছিলেন
বিজয়াদি। ভীষণ নৈর্ব্যক্তিক ভাব নিয়ে আসলে খুব আদর করে পড়াতেন। তাঁর কাছে পড়ে
অঙ্কে উৎসাহ হল। তখন বৃত্তি পরীক্ষা ছিল না আর। ‘সায়েন্স ট্যালেন্ট’-এ পাঠানো হল আমাকেও। স্কুল
আমায় ভরসা করছে দেখে মনে বড় আনন্দ হল। কিন্তু মুখচোরা বলে সবেতেই ছায়ার মতো,
অন্ধকারে মিশে থাকি। যত দাপট সবই শুধু স্কুলের বাইরে, পাড়ায়, বাড়িতে। এভাবেই দরিয়া
থেকে সাঁতরে এসে পড়লাম সমুদ্রে, ‘বড়বাড়ি’-তে। এতদিন স্কুলবাসে উঁচু ক্লাসের দিদিদের দেখেছিই শুধু...
এখন নিজেই সেবাড়ির অংশ। এই সেকেন্ডারি সেকশনে আসার পর প্রথম অনুভব করলাম ‘নিবেদিতা স্কুল’-এর আসল আত্মাটিকে! খুব অল্প
সময়েই জমে গেল দুজনের। যেমন শুনেছিলাম, মোটেই সেরকম কড়া আর দূরের বলে মনে হল না! দিদিরা
ভালবাসেন। আদর করে কথা বলেন। ফাঁকি দিই দেখে বকাঝকা করেন, হতাশ হন আর পড়াশোনার সাথে সাথে
একগাদা অন্য কাজের দায়িত্ব দিতে থাকেন। প্রতি ক্লাসে তখন সহপাঠীদের ভোট পেয়ে ‘ইউনিয়ন মেম্বার’ নির্বাচিত হচ্ছি। মনিট্রেস
শব্দেরই অন্য গালভরা সংস্করণ। বছরে এক দু’বার সব ক্লাসের সমস্ত সেকশনের ইউনিয়ন মেম্বারদের
ডেকে আলাদা মিটিং হচ্ছে। সেখানে কাকলীদি, বড় অর্চনাদি থাকেন। একটা অফিশিয়াল মিটিং-এর চেহারা কিরকম হয়,
স্কুলজীবনেই তার হাতেখড়ি। আমাদের কাজ থাকত মেলা। খাতাপত্র, রেজিস্টার, ম্যাপ
ইত্যাদি এক বিল্ডিঙ থেকে আর এক বিল্ডিঙের ক্লাসরুম অবধি আনা নেওয়া, ক্লাসের
শৃঙ্খলা রাখা, কে কী অসুবিধেয় আছে সেসব লক্ষ্য রাখা... তাকে দরকারে পড়া বুঝিয়ে
দেওয়া, উৎসাহ দেওয়া, নোটস বোঝানো এবং ক্লাসের সকলের আর ক্লাসটিচারের মধ্যে বাফার
হয়ে উপস্থিত থাকা। প্রতি বছর এভাবে ‘ইউনিয়ন মেম্বার’ হতে হতে জীবনের একটা বিরাট শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল অজান্তেই। যাকে
বলে ‘মাস ইন্টার্যাকশন’ এবং মানুষের পালস বোঝা। পুরো স্কুলজীবনে আমার খুব কাছের যে
দু’-তিনজন বন্ধু ছিল সকলেই স্ট্যান্ড করত। আমার নিজের রেজাল্টও ভালই হতো। কিন্তু
গোটা ক্লাস, বিশেষ করে যারা রেজাল্টে একেবারে শেষের দিকের, কী অজ্ঞাত কারণে জানি
না, প্রত্যেকে আমায় খুব ভালবাসত, বিশ্বাস করত। প্রতিবছর অ্যানুয়ালের রেজাল্ট
বেরনোর দিনগুলো তাই আমার কাছে খুব যন্ত্রণার ছিল। ক্লাসের বিভিন্ন দিক থেকে
কান্নার রোল উঠত আর নিজেকে বড় অপরাধী মনে হতো। বুঝতাম, এদের অনেকের সঙ্গেই আর কখনও
দেখা হবে না, কথা হবে না। অথচ প্রতিবারই আমাকে অবাক করে দিয়ে নতুন ক্লাসের গরমের
ছুটিতে, অন্য স্কুলে টিসি নিয়ে চলে যাওয়া এইসব বন্ধুদের চিঠি আসত! স্কুল ছেড়ে অনেক
অভিমানে চলে গিয়েও তারা আমাকে ভোলেনি কোনওদিন। সেই সময় যখন ঘরে ঘরে ল্যান্ডলাইন
টেলিফোনও আশ্চর্য প্রদীপের মতো, আমাদের সেইসব সুগন্ধি কালিতে, রঙিন রাইটিং প্যাডে
লেখা খামবন্ধ চিঠি, ইনল্যান্ড লেটার আর পোস্টকার্ডের আবেগই ছিল আলাদা!
সেই জমানায় নয় নয় করে প্রতিবছর গরমের বা পুজোর ছুটিতে দু’তিনজন দিদির বাড়িতে গিয়ে পাত পেড়ে চর্ব্যচোষ্য খেয়ে এসেছি, এমনই রেলা তখন আমাদের। পৌলোমী আর শতরূপার সঙ্গে সল্টলেকে মালবিকাদি, ঝর্ণাদির বাড়ি আর একদিন ক্লাসশেষে কাছেই হাতিবাগানে, কমলা বসুদির বাড়িতে গিয়ে (ওঁরই গাড়ি চড়ে) জীবনের প্রথম মোগলাই পরোটা খেয়ে এসেছিলাম আমি আর শবনম রহমান! প্রতিটি ক্লাসে তখন গানের দায়িত্ব আমার ওপর। হারমনিয়াম ছিল দুটো। একটা সেকেলে, একটা মাত্র কাঠের বেলো। আর একটা নতুন, ভাঁজ করা বেলো। তাদের রিড, স্টপার, হাতল সব নাড়িনক্ষত্র আমার চেনা। সমস্ত অনুষ্ঠানে লিড করা, ক্লাসকে গান তোলানো সব আমার দায়িত্ব। হাতের লেখা ভাল, ছবি আঁকতে পারি... তাই প্রতিবছর পনেরই অগাস্টের চার্টে লেখা আর আঁকায় সামিল হচ্ছি। সমস্ত র্যাপিড রিডিং ক্লাসে, যাবতীয় পাঠে এবং কোনওদিন ক্লাস না হলে, কোনও গল্প পড়ে শোনানোর থাকলে কী সবাই মিলে গান শুনবে বলে বায়না করলেও এই শর্মারই ডাক পড়ে! প্যারেডে কমান্ড দিচ্ছি, রচনা কম্পিটিশনে নরেন্দ্রপুর যাচ্ছি, গরমের ছুটিতে স্পেশাল কম্পিউটার ক্লাস করছি, শীতে ক্যাম্প আর রক ক্লাইম্বিং কোর্সে যাচ্ছি, স্কুল নিয়ে স্টেটসম্যানে লেখা বেরোলে প্রধান লেখাটা আমাকেই লিখতে বলা হচ্ছে... সব মিলিয়ে একটা তূরীয় জগতে নেশাচ্ছন্নের মতো আছি! পাড়ার খেলাধূলোর আড্ডাগুলো কমে যাচ্ছে ক্রমশ। সমস্ত সময়টা জুড়ে চেতনা শাসন করছে নিবেদিতা স্কুল।
সেই জমানায় নয় নয় করে প্রতিবছর গরমের বা পুজোর ছুটিতে দু’তিনজন দিদির বাড়িতে গিয়ে পাত পেড়ে চর্ব্যচোষ্য খেয়ে এসেছি, এমনই রেলা তখন আমাদের। পৌলোমী আর শতরূপার সঙ্গে সল্টলেকে মালবিকাদি, ঝর্ণাদির বাড়ি আর একদিন ক্লাসশেষে কাছেই হাতিবাগানে, কমলা বসুদির বাড়িতে গিয়ে (ওঁরই গাড়ি চড়ে) জীবনের প্রথম মোগলাই পরোটা খেয়ে এসেছিলাম আমি আর শবনম রহমান! প্রতিটি ক্লাসে তখন গানের দায়িত্ব আমার ওপর। হারমনিয়াম ছিল দুটো। একটা সেকেলে, একটা মাত্র কাঠের বেলো। আর একটা নতুন, ভাঁজ করা বেলো। তাদের রিড, স্টপার, হাতল সব নাড়িনক্ষত্র আমার চেনা। সমস্ত অনুষ্ঠানে লিড করা, ক্লাসকে গান তোলানো সব আমার দায়িত্ব। হাতের লেখা ভাল, ছবি আঁকতে পারি... তাই প্রতিবছর পনেরই অগাস্টের চার্টে লেখা আর আঁকায় সামিল হচ্ছি। সমস্ত র্যাপিড রিডিং ক্লাসে, যাবতীয় পাঠে এবং কোনওদিন ক্লাস না হলে, কোনও গল্প পড়ে শোনানোর থাকলে কী সবাই মিলে গান শুনবে বলে বায়না করলেও এই শর্মারই ডাক পড়ে! প্যারেডে কমান্ড দিচ্ছি, রচনা কম্পিটিশনে নরেন্দ্রপুর যাচ্ছি, গরমের ছুটিতে স্পেশাল কম্পিউটার ক্লাস করছি, শীতে ক্যাম্প আর রক ক্লাইম্বিং কোর্সে যাচ্ছি, স্কুল নিয়ে স্টেটসম্যানে লেখা বেরোলে প্রধান লেখাটা আমাকেই লিখতে বলা হচ্ছে... সব মিলিয়ে একটা তূরীয় জগতে নেশাচ্ছন্নের মতো আছি! পাড়ার খেলাধূলোর আড্ডাগুলো কমে যাচ্ছে ক্রমশ। সমস্ত সময়টা জুড়ে চেতনা শাসন করছে নিবেদিতা স্কুল।
বাড়ি এসে পড়ার দরকার পড়ে না। টিউটর তো কোন ছার! ক্লাসে যা পড়ি মন দিয়ে, ছবির
মতো গেঁথে যায় মনে। দ্রুত অথচ পরিস্কার হাতের লেখায় নোটস কীভাবে নিতে হয় শিখে গেছি নিজেই। নোটস
নিতে নিতেই পড়া মুখস্থ হয়ে যায়। আর কী সেই পঠন-পাঠন! এক একটা বিষয় যেভাবে পড়িয়েছেন
আমাদের দিদিরা, পরে তাবড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও কাউকে ওভাবে পড়াতে দেখিনি। মানসীদির
কাছে ভূগোল আর কমলা সেনদির কাছে সংস্কৃত যে পড়েছে, চিরকালের মতো ওই বিষয়ে ভিত পাকা
হয়ে গিয়েছে তার! ইতিহাসের উত্তরেও বিজ্ঞানের অ্যাপ্রোচে কীভাবে পয়েন্ট করে এবং
দরকারে পাশে ছোট ছোট ম্যাপ এঁকে লিখতে হয়, শিখিয়েছিলেন শর্মিষ্ঠাদি। নিজে প্রেসিডেন্সির
ছাত্রী ছিলেন... ইউনিভার্সিটির স্ট্যান্ডার্ডেই ক্লাস এইটে পড়িয়েছিলেন আমাদের। আর একেবারে
অন্য আঙ্গিকে গল্পের মতো করে ইতিহাস পড়িয়েছিলেন মালবিকাদি। পার্বতীদির কাছে
ফিজিকাল সায়েন্স পড়া অন্য দুনিয়ার দরজা খুলে যাওয়ারই সামিল... পাঠ্যবইয়ের সমস্ত ভুলগুলো ধরিয়ে প্রথমে সঠিক
জিনিসটা শিখিয়ে নিতেন। তারপর বলতেন ‘বোর্ডের পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার জন্য নাও, এবার এইসব ভুলভাল,
ছাইপাঁশ মুখস্থ কর’। সিলেবাসের বাইরে গিয়েও,
দরকারে কত কী ব্যাখ্যা করেছেন! ক্লাস টেনে থ্রি-ডি অ্যাটমিক মডেল নিয়ে এসে বুঝিয়েছেন
‘বন্ডিং’ কীভাবে হয়! ইউরোপীয়
বিজ্ঞানীদের নানান কথা গল্প করে বলতেন মাঝেসাঝে; বিদেশের পড়াশোনার মানের সঙ্গে
এদেশের পার্থক্য নিয়ে দু’চারটে হতাশা আর বিরক্তিও কখনও সখনও বেরিয়ে আসত সেসব গল্পে। ক্লাস
টেনে, সিলেবাসে ছিল না তাও, কুনোব্যাঙের ডিসেকশন করিয়ে ফিজিওলজির প্রথম পাঠ
দিয়েছিলেন শুভ্রাদি। যে স্ট্যান্ডার্ডে উত্তর লিখতে শিখিয়েছিলেন, পরে বুঝেছিলাম তা
উচ্চমাধ্যমিক বা কোনও ক্ষেত্রে আসলে স্নাতকস্তরের পড়াশোনার মান! সেভেনের ইংলিশ
ক্লাসে ‘রূপা ক্লাসিকস’ এর ছোট ছোট ছবিওলা বইগুলো পড়তে দিতেন ছোট গীতাদি... নিজের
সংগ্রহ থেকেই। পেজমার্ক করাতেন বিভিন্ন কোটেশন দিয়ে। ইংলিশের ভকাবুলারি ওই একটা
ক্লাসেই লাফিয়ে অনেকদূর বেড়ে গিয়েছিল আমাদের। সঙ্গে ইংলিশ গল্প-উপন্যাস-কল্পবিজ্ঞান
পড়ার নিয়মিত অভ্যাস। বড় অর্চনাদি বা দীপ্তিদির বাংলা ক্লাসে পাঠ্যবইয়ের বাইরে
হাজারটা বিষয়ে জেনেছি প্রতিদিন। বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ...
বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ থেকে শুরু করে মুজতবা আলি, সুনীল-শক্তি-সন্দীপন, নবনীতা
দেবসেন, জয় গোস্বামী প্রত্যেকের সঙ্গে পরিচয়ের উঠোন ছিল সেইসব ক্লাস। শঙ্খ ঘোষের ‘সকালবেলার আলো’ থেকে শুরু করে তসলিমা
নাসরিনের ‘নির্বাচিত কলাম’... সব আলোচনাই জারি থাকত ক্লাসে। প্রতিটা ছুটিতে তিরিশ
পাতা করে বাংলা আর ইংলিশ হাতের লেখা ছিল বাধ্যতামূলক। কালিপেন ছাড়া লেখা বারণ ছিল,
যাতে হাতের লেখা খারাপ না হয়ে যায়। পরীক্ষা কীভাবে দিতে হবে তার প্রস্তুতিও করে
দিয়েছিল স্কুলই। কোনও প্রাইভেট টিউটরের পক্ষে যা ওভাবে করা সম্ভব না। কীভাবে খাতায়
কতটা মার্জিন রেখে, বিভিন্ন কালিতে হেডিং-সাবহেডিং দিয়ে লিখতে হবে গোটা ক্লাস
নাইন-টেন জুড়ে সেসব অনুশীলন করানো হয়েছিল সমস্ত পরীক্ষায়।
স্কুলে থাকাকালীন স্কুলের
বহুকিছু নিয়ে খারাপ লাগা আর অভিযোগ ছিল। সুযোগ পেলেই দু’কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হতো
অনেক বিষয়ে। হাতের কাছে বন্ধুর মতো যাঁকে সবসময় সুখেদুঃখে পেয়েছি, সেই স্বরূপাদি
তো বটেই, আলোচনা সমালোচনার এমন খোলা হাওয়া দিয়েছিলেন আরও অনেক দিদিই। ক্লাস এইটে ঝর্ণাদি
আমাদের উষ্মা আর অসন্তোষ টের পেয়ে বলেছিলেন “আদর্শ শিক্ষিকা কেমন হওয়া
উচিৎ বলে মনে করি” এবিষয়ে রচনা লিখে জমা দিতে! মুখে মুখে তর্ক না করলেও
চ্যাটাং চ্যাটাং করে অনেক কথাই অনেক সময় বলেছি আমরা অনেকেই। বিশেষত এই চুল কাটা
যাবে না কেন, সবাইকে দুটো ঝুঁটি বা বিনুনি করতে হবে কেন বা এই প্রচন্ড ভিড়বাসে বা
ঝড়জলেও কী মরতে শাড়ি পরে আসতে হবে... এইসব নিয়ে! স্কুলের ভেতর জুতোমোজা খুলে
আমাদের বসতে হতো। তাই যে যা খুশি জুতো পরে আসত। বাইরের লোকেরা তা নিয়ে আমাদের
কটাক্ষও করেছে কখনও। সবাইকে একরকম জুতো পরে আসতে বলা হয় না, অথচ ইউনিফর্ম নিয়ে এত
কড়াকড়ি... অভিযোগ ছিল এ-নিয়েও। ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠতে এত মেয়েকে ফেল করিয়ে
ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিয়ে অন্য স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, সে নিয়েও মনের মধ্যে
অনেক বিষাদ আর উষ্মা ছিল। টের পেতাম, ভাল মেয়ে বলে চিহ্নিত হয়ে আছি যারা (সেই
সংখ্যাটা কিছু কম ছিল না), তাদের বহুকিছুতে স্বাধীনতা রয়েছে আর যারা সাধারণ বা
অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে... ক্রমশই বিচ্ছিন্ন, একলা হতে থাকছে। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসহীনতা, নিজেদের
এলেবেলে বলে ভাবার একটা প্রবণতা দেখেছি। দুর্গাকে প্রচন্ড মারধোরের পর যখন আদর করে
অপুকে কোলে টেনে নিতেন সর্বজয়া, যেমন মাথা হেঁট হয়ে আসত অপুর... বহুদিনই সেইসব
বন্ধুদের এমন অনেক লাঞ্ছনায় মাথা হেঁট হয়ে গেছে আপনা আপনি। তাদের হয়ে সমস্ত শাস্তি
যেমন মাথা পেতে নিয়েছি একাধিকবার, নিজেও বহু দুষ্টুমি করে তেমন পার পেয়েছি। কত
রসিকতা, ফাজলামি করেছি দিদিদের সঙ্গে। মহাজ্ঞানীর মতো অযাচিত বক্তব্য রেখেছি আবার ভুল ধরিয়ে দিলে
মুহূর্তে স্বীকার করে সংশোধন করেছি নিজেকে। এইরকম একটা অতিসক্রিয়তায় অনেকটা
দায়িত্ব, আস্থা আর আত্মবিশ্বাসে কেটে গিয়েছিল স্কুলজীবন। ভাবলে অবাক লাগে, কেউ
কখনও চুপ করিয়ে দেননি। প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছেন এবং ধৈর্য ধরে বুঝিয়েছেন, একটা
প্রতিষ্ঠানের অংশ হয়ে থাকার ভাল খারাপ দুদিকই কীভাবে মেনে চলতে হয়। স্কুলের শেষের
দিকটা হঠাৎ করে আত্মমগ্ন হয়ে পড়ছিলাম সকলে। পড়াশোনায় মন দিয়ে, নিজেদের গুছিয়ে নিতে
গিয়ে অনেক কিছু পাল্টাতে থাকছিল। পাল্টে যাচ্ছিল বন্ধুত্বগুলোও। স্কুল থেকে আসন্ন
বিদায়ের জন্য যেমন একটা মনখারাপ ঘিরে থাকত সেসময়, আগামী জীবনের, অজানিতের জন্য
একটা উৎকণ্ঠা মিশ্রিত উত্তেজনাও। শেষ সরস্বতী পুজোর পরদিন, যেদিন বিদায়ী ছাত্রীরা
বরণ করে সরস্বতীকে, শাড়ি পরে যাইনি বলে আমায় একা বসিয়ে রাখা হয়েছিল বারান্দায়। খুব
খারাপ লেগেছিল এত নিয়মকানুনের বেড়াজাল দেখে। জীবনে কখনও কোনও ঠাকুর বরণ করিনি,
ইচ্ছেও করেনি। ছোট থেকে পুজো-আচ্চার আবহাওয়ায় বড় হইনি, ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে
অনেক আপত্তি আর উন্নাসিকতা ছিল। কিন্তু সেদিনের সেই খারাপ লাগাটা এমন বেজেছিল যে
মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হওয়ার পর যখন স্কুলের মধ্যে তৃতীয় হলাম, তখন ছেলেমানুষের
মতোই বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, এসব বরণ টরণ না করলেও তাহলে হয়, বলুন? স্কুলের সঙ্গে
এরকমই তিক্ততা আর মাধুর্যের, সমর্পণ আর ঔদ্ধত্যের, বশ্যতা আর স্বাতন্ত্র্যের
সম্পর্ক ছিল আমাদের।
তারপর...
স্কুল
থেকে বেরিয়ে যখন কলেজে ঢুকলাম একটা অপরিমেয় স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলাম। ইচ্ছেমতো
পোশাক পরে ক্লাসে যাচ্ছি, ইচ্ছে করলেই ক্লাস না করে বেরিয়ে যাচ্ছি... বিরাট একটা
সবুজ মাঠে দাপিয়ে বাস্কেটবল খেলছি, সাইকেল চালাচ্ছি... যে খেলাধুলোর সুযোগ, যে
নিতান্ত জৈবিক আনন্দগুলো স্কুল কখনও দেয়নি। বহু ভাষাভাষী ছাত্রীদের সঙ্গে ক্লাস
করছি। একটা কসমোপলিটান ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে পা। উঠোনটা বড় হচ্ছে আমাদের। নতুন
চোখে দেখছি জীবনকে, যার অনেককিছুই এতদিন অধরা, অজানা ছিল। কিন্তু কিছুদিন পরই
বুঝলাম, মাথার ওপর থেকে ছায়াটা হঠাৎ সরে গিয়েছে। ধূ ধূ রোদে দাঁড়িয়ে আছি! পরীক্ষা-পড়াশোনা-কেরিয়ার
সব আমার নিজের দায়িত্ব। আমি করলে হবে, না করলে হবে না। না করলে কেউ ডাকবে না,
জিজ্ঞেস করবে না কী ব্যাপার! শাস্তি দেবে না। বুঝিয়ে দেবে না। ভাল করলে উৎসাহ দিয়ে
দুটো মিষ্টি কথা বলে যাবে না। হাড়েমজ্জায় টের পেলাম নিবেদিতা স্কুলকে, তার না
থাকার মধ্যে দিয়ে। প্রথম ক’টা বছর শুধু আনলার্ন করতেই চলে গেল। নিবেদিতায় যখন ভর্তি
হয়েছিলাম একরকম ‘আদারনেস’ ছিল। বেরনোর সময় আর এক। ভাষা-আচার ব্যবহার-সৌজন্য-পরিচ্ছন্নতা-আন্তরিকতা
সবেতেই। কিন্তু আমরা তো ‘নিবেদিতা স্কুল’। আমরা ঝকঝকে, চৌকস। খুব দ্রুততায় তাই মানিয়ে নিতে থাকলাম নিজেদের আর ক্রমশ ছাড়িয়ে
নিতে থাকলাম নিবেদিতার শিকড়... তখনও আষ্টেপৃষ্টে যা জড়িয়ে আছে আমাদের... যা আমাদের
বড় হতে দিচ্ছে না, আরও একা, আরও অভিমানী আরও এলিয়েন করে দিচ্ছে ক্রমশ।
বুঝলাম কী ঐশ্বর্যের মধ্যে কেটেছে
এতগুলো বছর। যে সময়ে আমি স্কুলকে পেয়েছি, সেই নব্বইয়ের দশকে কয়েকজন অবিশ্বাস্য শিক্ষিকা
ছিলেন স্কুলে। বলতে গেলে সেটা হয়তো স্কুলের স্বর্ণযুগ! কী নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন
প্রত্যেকে ভাবলে বিস্ময় জাগে! কত সামান্য বেতনে, কোনও তথাকথিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা না
রেখেই নিজেদের গোটা জীবন আমাদের জন্য এভাবে উৎসর্গ করে গেলেন। সাধারণ আটপৌরে শাড়ি... কোনও সাজ নয়, কোনও
আড়ম্বর নয়... কী সাদামাটা জীবনযাপন ছিল তাঁদের! চোখের সামনে দেখেছি নির্লোভ হয়ে
কোনও প্রত্যাশা না রেখে নিঃশব্দে কীভাবে কাজ করে যাওয়া যায়। বছরের পর বছর একই
উৎসাহ, উদ্যম, নিষ্ঠা আর ডেডিকেশন দিয়ে পড়ানো যায়। কখনও ক্লান্ত নয়, বরং সবসময় হাসতে দেখেছি, আনন্দে
থাকতে দেখেছি তাঁদের। একটা ভীষণ ইতিবাচক হাওয়া ঘিরে থাকত স্কুলটা জুড়ে। গৃহী এইসব শিক্ষিকাদের পাশে
আবাসিক যে সন্ন্যাসিনী ও ব্রহ্মচারিণী দিদিরা ছিলেন, তাঁরাও একইরকম ভালবাসায় আর
শাসনে ঘিরে ছিলেন আমাদের। অনেকেই অনেক উচ্চশিক্ষার পর রামকৃষ্ণ সারদা মিশনে যোগ
দিয়েছেন। স্কুলের অনুষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন বক্তৃতায় তাঁদের মেধা আর মননশীলতার পরিচয়
পাওয়া যেত। অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন অনেকে। কী গভীর পড়াশোনা ছিল তাঁদের। আসলে নিবেদিতা
স্কুলের শিক্ষিকাদের কাছে শিক্ষাটা পেশা নয়, একটা যাপন। একটা লাইফস্টাইল। তাই ওই
মাপ দিয়ে জীবনে আর কখনও কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে প্রত্যাশা রাখা উচিৎ না। বড়
ধাক্কা খেতে হয়। স্কুলে ভাল করুক না করুক, নিতান্ত সাধারণ ছাত্রীরাও কয়েকটা বড়
সম্পদ নিয়ে এবং স্বাতন্ত্র্য নিয়ে স্কুল থেকে বেরোয়। মেরুদন্ড সোজা করে বসে পড়ার
অভ্যাস, সঠিক উচ্চারণে সংস্কৃত পাঠ, নির্ভুল বানান, সুন্দর হাতের লেখা,
পরিচ্ছন্নতা, সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে কাজের সম্পাদনা, নিয়মানুবর্তিতা এসবই
ঐকান্তিকভাবে স্কুলের অবদান। ফোর-ফাইভ-সিক্স-সেভেন এই চারবছর মাটিতে আসন পেতে
বেঞ্চে খাতা রেখে লিখতাম আমরা। বৈদিক আশ্রমের মতোই ব্যবস্থা ছিল। ছাত্রীদের মধ্যে
দায়িত্ব ভাগ করা থাকত স্কুলবাড়ি পরিস্কার রাখার। স্কুলের পাশের বস্তির দুঃস্থ
বাচ্চাদের পড়ানো, বন্যা-দুর্যোগে অর্থসাহায্য করা, খাতাপত্র-জামাকাপড় দিয়ে সাহায্য
করা এমন কত আবশ্যিক অথচ সাধারণ্যে উপেক্ষিত দিক অলক্ষ্যে আমাদের চরিত্রে গেঁথে
দিয়েছে স্কুল।
বাড়িতে পড়াশোনা দেখিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না। বাবা-মা দুজনেই চাকরি করতেন। আরও
সহস্র রকমের সমাজসেবা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁরা। বহু
আত্মীয়-বন্ধু আর্থিকভাবে, সামাজিকভাবে নির্ভরশীল ছিল তাঁদের ওপর। তাই দুই মেয়ে
ছাড়াও আরও অনেকের দায়িত্ব ছিল ওঁদের কাঁধে। শুধুমাত্র নিবেদিতা স্কুলে পড়েছি বলে
আলাদা করে কোনও সময় দেওয়ার চাপ নিতে হয়নি তাই। আমার সমগ্র স্কুলজীবনে হাতে গুণে ক’বার বাবা-মা স্কুলে এসেছেন
তাও মনে পড়ে না! নিয়মিত টিফিন খেতাম না বলে একবার গার্জিয়ান কল হয়েছিল শুধু। আমাদের
শরীর-স্বাস্থ্যের দিকেও এতটাই নজর ছিল দিদিদের। ক্লাস ফোরে পরপর অনেকবার অসুস্থ
হয়ে এক মাসের বেশি স্কুলে উপস্থিত হতে পারিনি। বড়দি ভেবেছিলেন আমায় দেখতে আসবেন
বাড়িতে। বলেছিলেন, ধ্যানে বসতে পারছেন না, খুব বিচলিত হয়ে পড়ছেন আমার কথা মনে করে।
ক্লাস ফাইভে একদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। টিফিনের আগেই একটা ট্যাক্সি করে
বৃন্দাবনদাকে (আমাদের স্কুলের দ্বাররক্ষক) দিয়ে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।
ফাঁকা বাড়িতে ফিরে আমাকেই তালা খুলে ঢুকতে হয়েছিল। ফোন করা হয়েছিল মায়ের অফিসে।
খুব স্বাবলম্বীভাবে আমাদের দুই বোনকে বড় করেছিলেন বাবা-মা। বাড়িতে আন্তর্জাতিক
সাহিত্য, রাজনীতি আর সংস্কৃতির একটা খোলা হাওয়া ছিল। আমার মানসিক প্রেক্ষাপটে
প্রবল প্রভাব ছিল রাশিয়া-চীন-ইউরোপ-আমেরিকার সাহিত্যের। ক্লাস ফাইভেই প্রিয় বন্ধুর
সঙ্গে গল্প করছি পেরেস্ত্রৈকা, গ্লাসনস্ত নিয়ে... আর একটু বড় হয়েই পড়ছি নিক্কি
জিওভান্নি, পাবলো নেরুদা। বাড়ি ভর্তি বই... ভারতের প্রাচীন আর আধুনিক দর্শনের
সঙ্গে মিলেমিশে আছে আন্তর্জাতিক, বামপন্থী চিন্তাভাবনা আর প্রগতিশীলতা। আছে দেশেরই বিভিন্ন
প্রদেশের কবিতা, গল্প, উপকথা; দেশবিদেশের এপিক, ক্লাসিকস, অনুবাদসাহিত্য। স্কুল এসবের
অনেকটাই বিপ্রতীপে। পুরনো কলকাতার খড়খড়ি আর কড়িবরগার মতোই সাবেকি, সনাতনী। বাবা-মা এটাই চেয়েছিলেন।
ঐতিহ্য আর আধুনিকতা দুই দিক থেকে যাতে আমার জীবনকে জানবার পথ পরিপূর্ণতা পায়। যে
পাড়ায় বড় হয়েছি, তার পাশেই ছিল বস্তি। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করি যে জীবনের
ক্রূর আর নির্মম দিকগুলো দেখতে পেয়েছি ওই বস্তির জন্য। স্কুলও ঠিক এভাবেই আমার
জীবনে একটা অন্য পারস্পেক্টিভ দিয়েছিল। উত্তর কলকাতার গোঁড়া আর রক্ষণশীল আবহের
মধ্যে একটা নিরাপত্তার, একটা ভালবাসার জায়গা দিয়েছিল, মা-দিদিমার স্নেহের মতোই।
ফিরে তাকালে তাই বুঝি,
বাড়ির পরিবেশের বিপ্রতীপে এই কমপ্লিমেন্টারি দিকগুলো চিনিয়ে, ধরিয়ে দিতে স্কুলের
ভূমিকা কতখানি। স্কুল থেকে বেরনোর এত বছর পরও তাই স্কুলের প্রতি মমত্ব,
কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা শেষ হয় না আমাদের। স্কুলের জন্য অনেককিছু করতে ইচ্ছে করে। বলতে
ইচ্ছে করে সবাইকে, এরকম একটা গল্পের মতো ইশকুলবাড়ির কথা। বহু দূরদূরান্তে ছড়িয়ে
গেছে আমাদের স্কুলের মেয়েরা। জীবনের সবদিকেই তারা সুপ্রতিষ্ঠিত। যে যার নিজের মতো
করে নিজের জায়গা খুঁজে নিয়েছে। স্কুল যাদের কাছে টেনে নিতে পারেনি, যাদের ছিন্ন
করে দিয়েছে নিজের শাখা থেকে অথবা যারা স্কুলে থেকেও পায়ের তলায় জমি খুঁজে পায়নি
এমন অনেককেই দেখেছি এই অনুশাসন, নিয়ম আর কড়াকড়ির চাপে বদলে যেতে। এরকম অনেকে আর
কখনও স্কুলের কথা ভাবতে চায় না, স্কুলে আসতে চায় না। স্কুলকে পারলে মুছেই ফেলতে
চায় নিজেদের স্মৃতি থেকে অথবা জাগিয়ে রাখতে চায় শুধু নিজেদের মনে করিয়ে দিতে যে
কতটা কঠিন পথ বেয়ে আজ তাদের এই জায়গা করে নিতে হয়েছে। খুব স্বাভাবিক। এই সমস্ত
রাগ, অভিমান, যন্ত্রণা ঘুরেফিরে আসা সবই স্বাভাবিক। কৈশোরের সেইসব টালমাটাল দিনগুলোর মধ্যে স্কুলের
চাপানো নিয়মকানুন, শাসন, পড়াশোনার চাপ, তুলনা-প্রতিতুলনা সবাই একরকম ভাবে মেনে
নিতে পারেনি, পারে না। কিন্তু স্কুল, দিয়েছে তাদেরও। আজ তারা যে যেখানেই থাকুক, নিবেদিতার স্কুলের
ছাত্রীদের সিগনেচার উন্নাসিকতাই হোক বা সুন্দরের প্রতি, শিল্পের প্রতি মুগ্ধতাই
হোক বা কাজের প্রতি
নিষ্ঠা আর একাগ্রতাই হোক বা নাগাড়ে পরিশ্রম করার ক্ষমতা; চরিত্রের এমন অনেক দিকই
নীরবে তৈরি হয়েছে ওই উঠোনেই। যুগ পাল্টেছে। হাওয়া বদলেছে। স্কুলও বদলেছে অনেকবার। তবু
এখনও যখন দেখি পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার এত বছর পরেও মেয়েরা স্কুল সম্পর্কে, স্কুলের ভালমন্দ নিয়ে স্বাধীন মত প্রকাশ করতে ভয় পায়, সারভেইলেন্সের ভয় পায়, এখনও নিজেদের ভেতরের আটপৌরে আলাপ আলোচনার কথা স্কুলকর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে
নালিশ করে আসে, তখন মনে হয়
প্রশ্ন করবার, চ্যালেঞ্জ করবার
যে শিক্ষা স্কুল আমাদের দিয়েছিল...
স্বামী বিবেকানন্দের যে যে চারিত্র্যগুণ আমাদের আশৈশব পড়ানো হয়েছিল,সেগুলো কি তাহলে শুধু গল্পকথা হয়েই থেকে যাওয়ার? তখন মনে হয়, যা ছিল... দূর থেকেই ভাল ছিল বোধ হয়।
আসলে সত্যিটা এটাই যে, আমাদের সকলের ‘নিবেদিতা স্কুল’ আসলে কতগুলো আলাদা আলাদা
স্কুল। নিজের মনের মধ্যের সেই চিরপরিচিত নিজের ইশকুলটিকেই বোধ হয় বাঁচিয়ে রাখা
ভাল।
দোয়েলপাখি দাশগুপ্ত [১৯৯৬]
Pouchhe gechi tomader somoye :)
ReplyDeleteঅসামান্য এই অভিজ্ঞতার হাত ধরে নিজের ছোট্টবেলায় পৌঁছে গেলাম। আমার নিজের স্কুল(যোধপুর গার্লস) বাড়িকে মনে পরে চোখে জল এসে গেলো । কত বড় হয়ে গেলাম সবাই
Delete:)
Deletebhalo laglo tor ei chotto lekhatuku @Sreya
Deleteঅসামান্য লেখা...অনবদ্য... অন্ধকার থেকে আলোয় ফুটে ওঠার মতো লেখা...কী ভীষণ স্মৃতিকাতর করে তুললো এই লেখা আমাকে আমার নিজের স্কুলজীবন সম্পর্কেও...অদ্ভুত সুন্দর লেখা...
ReplyDeleteলেখ না তুইও সন্দীপন :)
Deleteতোর লেখা যখন পড়ি,তখন অদ্ভুত এক আবেশের মধ্যে নিজেকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ফেলি।ওই মায়াজালে এখনও জড়িয়ে আছি যে।দোয়েল,তুই একটা বই লেখনা রে,আমার নিবেদিতা স্কুল।
ReplyDeleteঃ)আমাদের সকলের স্মৃতি :)
Deleteঅসাধারণ লেখা দোয়েলদি। ভীষণ nostalgic.
ReplyDeleteথ্যাংক্স রে :)
DeleteDown the memory lane. khub nostalgic lagche.
ReplyDeleteধন্যবাদ সায়নী :)
DeleteKi bhalo likhechhis re.... khuti nati koto kichhu mone pore gelo tor lekha pore.... satti re kichhu kichhu su-abhyas amader ekebare rokte dhuke gechhe ei school er doulotei.... satti amra bhagyoboti je oi rokom ekta chhotro chhayay chhilam anekta samay, je samay ta amader mul choritro ta gore diyechhe....
ReplyDeletehnya go Arpitadi. :) bhalo laglo lekhata porechho jene...
Deleteonekkhon kandlam ! onek kotha mone pore gelo..!!
ReplyDelete...
Deleteআয় চোখ মুছিয়ে দিই। :)
Deleteপিছন ফিরে তাকাতে গেলে সবার আগে ইস্কুলের বিশাল বাড়িটাই চোখে পড়ে আমারও, আয়নার সামনে একলা দাঁড়ালেও নিজেকে স্কুল ইউনিফর্মেই দেখি হয়তো। আলাদা ইস্কুল, আলাদা গুরু। পঠনপাঠনের পদ্ধতি, রাগ-অভিমান, ঝগড়া-মারামারি সমস্তটাই অন্য রকমের। তবুও আপনার অনুভূতি ছুঁয়ে ফেলতে অসুবিধা হলো না একটুও।
ReplyDeleteভারী সুন্দর লেখা। শুক্লাদেবী যথার্থ বলেছেন, এই স্মৃতিরা একটা আলাদা বই হবার দাবী রাখে।
ভালো লাগল তুমি পড়েছ জেনে। যা আছে, মাথাতেই থাক। সেটুকুই আসল। না? :)
DeleteSchool life e school er Anek kichu amar Bhalo lagto na... Kintu aj Ai age ase mone hoi sedin school er Sei Anek kichu chilo bollei Ajo anno Aneker thake Alada Ami Anek khetre...
ReplyDeleteThanks Doel.
ReplyDeleteথ্যাংকস বিদিশাদি।
Deleteতোমার লেখা পড়ে অনেক ভুলে যাওয়া গল্প মনে পড়ে গেলো, দোয়েলপাখিদি।
ReplyDeleteআরো একটা নিখাদ কথা বলি? 'সুপুরিবনের সারি', বা 'সকালবেলার আলো'-র মতো খুব মন ছুঁয়ে যাওয়া কিছু পড়লে যেমন মনে হয় না, এমন তো নিজের অজান্তে আমিও ভেবেছি, কিন্তু লিখতে পারতাম কি কখনো, তোমার লেখা পড়লেও আমার ঠিক তাই মনে হয়।
আমার আসলে বয়স বাড়েনি রে। And sadly I don't forget anything! ভালোবাসা নিস টুপুর।
DeleteNicely said Doyel. Lots of memories attached to the school and the lane.
ReplyDeleteSayantani
1996 batch
And you were an intrinsic part of me. Love, always.
DeleteKi sundor likhecho didi. Mone holo nijer miner Kotha tai porchi. Mon chue gelo.
ReplyDeleteDhonyobad Bijuri.
DeleteTomar lekha amar sobsomoy khub priyo.Ei lekhar sathe ekdom sei somoy e pouche gechilum. osadharon..
ReplyDeleteThanks Rituparna
Delete