২০১৬র এপ্রিল মাসে খুব কঠিন রোগশয্যা থেকে উঠে দিন তিনেকের জন্য দার্জিলিং গেছিলাম। মনে একটা ইচ্ছে ছিল, রায়ভিলা গিয়ে সেই বাড়িটি দেখে আসব, যে বাড়িতে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন সিস্টার নিবেদিতা। পথ সামান্যই ছিল। কিন্তু অশক্ত শরীরে তাই মনে হল অনেক। নিজেকে মনে হল তীর্থযাত্রী। দূর থেকে রায়ভিলার সুন্দর সাদা-সবুজ বাড়িটি দেখতে পেয়ে আনন্দ হল খুব। যখন পৌঁছলাম, ছোট বাচ্চারা একটা ঘরে বসে গুরুস্তোত্র মুখস্থ করছিল। আবাসিক সন্ন্যাসীরা ব্যস্ত ছিলেন যে যাঁর কাজে। কাঠের সিঁড়ির বাইরে জুতো খুলে দোতলায় গেলাম, সেই ঘরে, যেখানে সিস্টার বসে পড়াশোনা করতেন, লিখতেন। সেখানে এখন উপাসনালয়। দেখে এলাম সিস্টারের ব্যবহৃত চেয়ার, টাইপরাইটার। দেখে এলাম সেই ঘর, যেখানে নিমজ্জমান তরীটি থেকে তিনি সূর্যোদয় দেখেছিলেন... সমস্ত সময় জুড়ে মনটা আর্দ্র হয়ে ছিল। পালিশ করা কাঠের মেঝে, জানালার বাইরে পাহাড়। পাখি আর প্রজাপতিরা ছোটাছুটি করছে বাগানময়। কিছুটা আত্মমগ্ন হয়ে আমি বসে আছি, এমন সময় একজন ব্রহ্মচারী এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "সিস্টার নিবেদিতার কথা শুনেছেন?" এতক্ষণের সমস্ত ভাববিভোর তন্দ্রা কেটে গেল। আমি বলে ফেললাম, "শুনব কী করে! সিস্টার নিবেদিতার কথা কেউ কি জানে?" শুনে তিনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে একটু অপ্রতিভ হাসলেন। বললেন, "হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসলে সেজন্যেই আমরা ঠিক করেছি আগামী কয়েক বছর তাঁর খুব নামগান করব। সামনেই তো ওঁর দেড়শ বছরের জন্মদিন।" আমি ক্ষমা চেয়ে বললাম, "আসলে আমি সিস্টার নিবেদিতা স্কুলের ছাত্রী। ছোটবেলা থেকে এই বাড়ির কথা, সিস্টারের বলা সেই শেষ বানী, তাঁর সমাধিতে খোদাই করা এপিটাফ এগুলো জেনে থেকে মনে একটা ইচ্ছে ছিল কোনও একদিন এবাড়িতে আসব"। শুনে তিনি খুব খুশি হলেন। অনেকক্ষণ তারপর কথা হল সিস্টারকে নিয়ে, আশু অনেক কর্মসূচী নিয়ে।
নিবেদিতা স্কুলে পড়ার সুবাদে আমরা যেভাবে যতটা সিস্টারের কথা জেনেছি, বাইরের জগত জানে তার চেয়ে অনেক কম। ১০০% বাঙালি রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দের নাম জানলেও অনেকেই আজও সিস্টারের নাম শোনেননি। যে পোড়াদেশের জন্য নিজের ঘরবাড়িদেশ ছেড়ে একবাক্যে চলে এলেন ওই অল্প বয়সে; ভিন্ন জল-হাওয়ায়, সংস্কৃতিতে মানিয়ে গুছিয়ে অকল্পনীয় পরিশ্রম আর কর্মযজ্ঞের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, সে-দেশ তাঁকে মনে রাখল কী রাখল না এসব ঠুনকো বিষয় নিয়ে চিন্তা করে আয়ুক্ষয় করার মতো মানুষ তো তিনি নন। তিনি নিবেদিতা। অপরিমেয় শক্তি আর সাহস নিয়ে, দুঃসাধ্য কাজের সংকল্প নিয়ে... জেদ, পরিশ্রম আর সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে তাঁর যাত্রা। জীবনে কাজকে ঈশ্বরপ্রতিম জ্ঞান করেছেন। অসহনীয় শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক কষ্টের মধ্যেও লক্ষ্যে অবিচলিত থেকেছেন। উত্তর কলকাতার রক্ষণশীল পাড়ায় মেয়েদের স্কুল খোলা থেকে শুরু করে ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবের কর্মকান্ডের অংশীদার হওয়া বা দেশের শিল্প-বিজ্ঞান-ইতিহাস নিয়ে গবেষণা ও চর্চার পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রেরণা জুগিয়ে তিনি সঠিক অর্থে এদেশের আত্মাটিকে উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিলেন। আমাদের সকলের চেয়ে মনে-প্রাণে, কথায়, কাজে তিনি অনেক বেশি ভারতীয়, "...who gave her all to India".
আজ সিস্টারের সার্ধশতবর্ষপূর্তির দিনে, তাঁর স্কুলের ছাত্রী হিসেবে অনেক শ্রদ্ধা ভালবাসা ও গর্বের সঙ্গে অপাঠ্য-র এই সংখ্যাটি উৎসর্গ করলাম আমরা। এবারের বিষয় ছিল সিস্টার নিবেদিতা ও তাঁর স্কুল। প্রাক্তন ছাত্রীদের পাশাপাশি এবারের অপাঠ্যয় রইল স্কুলের বাইরের মানুষজনেরও শ্রদ্ধার্ঘ্য। আই আই এস সি-র বিজ্ঞানী, বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র ও অধ্যাপকদের লেখা, একজন অভিভাবকের লেখাও, যিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল কবি। প্রাক্তনীদের লেখার মধ্যে রইল সিস্টারের জন্মস্থান ডানগানন থেকে ঘুরে আসা একটি ট্রাভেলগ, স্কুলের নানান অনুষঙ্গ আর মজার কথা, স্মৃতিচারণ, নস্টালজিয়া। আর রইল, আমাদের ফেসবুকের বৈঠকী গ্রুপ "আমাদের ইশকুল"-এর কিছু নির্বাচিত আড্ডার সংকলন।
রইল সিস্টার নিবেদিতার সমস্ত লেখার সংকলন এবং তাঁকে নিয়ে লেখা অনেক বইয়ের লিংক, "প্রবুদ্ধ ভারত"-এর বছরের বিশেষ নিবেদিতা সংখ্যাও।
বরাবরের মতোই এবারের সংখ্যাও সম্পাদনা করেছে একই টিম। যদিও এক শহরে নেই কেউই।
সবাইকে অনেক শুভেচ্ছা, ভালবাসা আর ধন্যবাদ জানিয়ে
দোয়েলপাখি দাশগুপ্ত
সম্পাদক (১৯৯৬)
সহযোগিতায়ঃ
মন্দাক্রান্তা দাশগুপ্ত (২০০৪)
প্রমিতা মৈত্র (২০০৮)
ডালিয়া ঘোষ দস্তিদার (১৯৯৬)