খুদিমামার গাছেরা


একদিন সকালে খুদিমামা এসে দিদিকে বলল, “বুঝলি দোলা, নতুন একটা দোকান করছি। ভালো করে ডেকরেট করতে হবে। শস্তায় কিছু ভালো গাছপালা পেলে হত। কোত্থেকে পাই বল তো?” মায়ের চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট এই তুতো ভাইটিকে আমরা মামা বললেও সম্পর্কটা দাদার মতই ছিল দিদি তখন ডাক্তারি পড়ছে। আদ্ধেক সময়ে হস্টেলে থাকে। মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। গ্রেজ অ্যানাটমিটা সরিয়ে রেখে পেন চিবাতে চিবাতে বিজ্ঞের মতো বলল,“ও তুমি ভেবো না মামা। আমি যোগাড় করে দেব।আমি তখন দিদির এক নম্বরের সাগরেদ। ডান হাত যাকে বলে। বসে বসে ফিজিক্যাল সায়েন্স পড়ছিলাম আর শুনছিলাম। শিগগির একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে বুঝতে পেরে বেশ শিরশির করছিল শিরদাঁড়াটা। খুদিমামা নিশ্চিন্ত হয়ে আমাদের সঙ্গে খানিকক্ষণ আড্ডা দিয়ে, রান্নাঘরে গিয়ে দিদি কি কচ্ছিসবলে মাকে জক দিয়ে চপ চাউমিন সাঁটিয়ে ফিরে গেল।
রাতে বিছানায় শুয়ে দিদিকে জিগালাম, “হ্যাঁরে দিদি, গাছ পাবি কোত্থেকে?” শখ করে বারান্দায় কয়েকটা গাছ লাগিয়েছি তখন। ল্যাভেন্ডার, বল লিলি, উইপিং মেরী। শঙ্কিত ছিলাম, বদান্যতায় পাছে সেগুলোই বেহাত হয়ে যায়! দিদি নিরাসক্ত গলায় বলল, “কেন? ভুটকির থেকে ঝাড়ব।আমি শুনে থভুটকির গাছ ঝাড়বি! জানতে পাল্লে?”
ভুটকি ছিল আমাদের প্রতিবেশিনী। নেক্সট ডোর নেইবার। তার একটা সুন্দর নাম ছিল বটে... কিন্তু এ নামটা আমরা ভালবেসে দিয়েছিনু। বলাই বাহুল্য, এ পুলকের বহিঃপ্রকাশ কোনOওদিন তার সামনে ঘটেনি। তার অপরাধ ছিল অগাধসারাদিন দুইখান বেণী দুলিয়ে সে খুকুপনা করত, আধো-আধো কথা বলত আর কথার মাঝে মাঝে টুক টুক করে তার কচ্ছপের মত ঘাড়খানা নড়ত। এ অবধি তবুও সয়েছিলকিন্তু নিঝুম দুপুরে হারমনিয়াম টেনে নিয়ে বসত যখন... তাবৎ বন্দীশ ভুলে আমরা আঁকুপাঁকু করতাম। বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডেজির আদ্যশ্রাদ্ধটি  গড়াত বিকেল অবধি। ভুটকির বর কাকু মানুষটি ছিলেন একেবারে উল্টোঅমায়িক, স্নেহপ্রবণ, রোগা। বাণী বসুর কোনও একটা গল্পে পড়েছিলাম এক মানিকজোড়ের কথা। কাগা বগা হুঁকোর খোল/ গুড়্গুড়ে মাদল ঢ্যাপ্পা ওললেখিকা শিওর এদের দেখেছিলেন।  যাক গে যা বলছিলাম, ভুটকির ওপর আমাদের দীর্ঘ দিনের খার ছিল। এই মওকায় তার পিতিশোধ নেওয়া যাবে ভেবেই দিল খুশ হয়ে গেল। আর ঝাড়াঝাড়িতে দিদি আমার সাধকগুরু। তাই খানিক নিশ্চিন্দি হয়ে পাশ ফিরে শুলাম।
দুদিন পর খুদে ফোন করল।  কি রে গাছ যোগাড় হল?” দিদিকে রিসিভারটা ধরিয়ে দিতেই দিদি নিরুত্তাপ গলায় বলল, “হ্যাঁ খুদিমামা, তুমি আজ বিকেলেই চলে এস।আমি বললাম, “আজই?” দিদি বলল, “আজ কি বার?” বললাম, “রোববার! দিদি বলল, “একটু পরেই ভুটকি আসবে ঘাড় নাড়তে নাড়তে আর খুকিপনা করবে মায়ের সঙ্গে বসে। ও যখন এসব করবে সেই সময় আমরা ওর ফ্ল্যাটে ঢুকে কয়েকটা টব ঝেড়ে দেব।” আমি আঁতকে উঠে বললাম, “কাকু থাকবে তো! দিদি বলল, “আঃ! আজ না রোববার? কাকু ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গেছে হস্টেলেআমি বললাম, “রাইইইট!
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুটকি এসে গেল। কিন্তু মুশকিলে ফেলল মা! সারা সপ্তাহের ক্লান্তির পর মার সেদিন ইচ্ছে করছিল একটু গড়ায়। ভুটকামি পোষাচ্ছিল না। খবরের কাগজ নিয়ে মা সোজা পাশের ঘরে চলে গেল। আমরা পড়লাম ফাঁপরে। দিদি তখন এস এস কাকিমা... বলে ভুটকিকে ডেকে নিয়ে খাটে বসিয়ে গল্প শুরু করে দিল। ভুটকি হলে কী হবে, সন্দেহ হয়েছিল তারও। কে আমায় দু'চক্ষে দেখতে পারে না, সেটা বোধ হয় নির্বোধেও বোঝে! দিদির আতিথেয়তায় প্রাথমিক ভাবে ঘাবড়ে গেলেও শেষমেশ গল্প জমে উঠল। আম্মো সুযোগ বুঝে টুক করে চলে গেলাম ওদের ফাঁকা ফ্ল্যাটে। দরজাটা ভেজানো ছিল। চলে গেলাম বারান্দায়। বুক ঢিপঢিপ করছিল। যদি আশপাশের বাড়ি থেকে কেউ দেখতে পায়? কিম্বা কোনও সেলসম্যান এসে বেল বাজায়? অথবা ভুটকি বা কাকুফিরে আসে? তাড়াতাড়ি ভাল ভাল কয়েকটা গাছ বেছে কোলে করে পাঁইপাঁই করে দৌড়ে ঢুকে পড়লাম একেবারে আমাদের স্টোর রুমে।
বিকেলেই খুদিমামা চলে এল। দিদি বলল, গাছগুলো চুপিসাড়ে নিয়ে যাও। খুব শস্তায় পাইনি আসলে। এত খরচা হয়েছে জানলে মা আবার রাগ করবে। তাই লুকিয়ে রেখেছি। ওই যে স্টোর রুমে, বিছানার আড়ালে। খুদিমামা গালগল্প সেরে (সেদিন গাড়িটা এনেছিল) টবগুলো নিয়ে গেল। কয়েকদিন পর ভুটকি এসে মাকে বলল, “দান দিদি, আমাল পাতাবাহাল আল ছুন্নোল ছব তব কি কয়ে দেন চুয়ি হয়ে গেসে। একতা তব না নিচে পলে ভেঙ্গেও গেসে।দিদি আর আমি তখন খুব জোরে জোরে চিৎকার করে পড়া শুরু করেছি।

মাস দুই পরে খুদিমামা ফের ফোনাল। তোদের গাছগুলো খুব সুন্দর লাগছে রে দোকানে। একদিন এসে দেখে যা। খাওয়াদাওয়াও করে যা। আর এক জনের সঙ্গে আলাপও করিয়ে দেব। তবে দিদি জামাইবাবুকে এখনই কিছু বলিস না যেন! শুনেই মালুম হল এ নিশ্চই খুদেমামি। আমরা বললাম, “পাআআআগল?”
দোকানে আর যাওয়া হল না। কারণ তার আগেই হবু মামিকে বগলে নিয়ে মামা হাজির। সেদিন শনিবার বিকেল। আমার ইশকুলে গরমের ছুটি। দিদিরও ফার্স্ট সেমিস্টার শেষ। একেবারে ঝাড়া হাত পা (আক্ষরিক অর্থেই)মা বাবা আপিসে। আলাপ পরিচয় সারার পর খুদিমামা বলল, “শোন না, আমার আরও কয়েকটা গাছ লাগবে বুঝলি? কিন্তু এবার তোরা পয়সা নিবি। আগের বার পয়সা নিসনি। এবার আর তা করিস না। আর ইয়ে...গাছগুলো একটু বড় হলে ভাল হয়। চেষ্টা করিস মানে...ধর... এরিকা পাম গোছের কিছু...দিদি বলল, “এররর... বড় গাছ হতে গেলে একটু সময় লাগবেমামা বলল, “আচ্ছা, বেশি সময় লাগলে বলিস। তাহলে আমি আমার দোকানের ছেলেগুলোকে দিয়ে শিয়ালদা থেকে কিনিয়ে আনব না হয়। আসলে ওগুলোর তো রুচি বলতে কিস্যু নাই। নিয়ে আসবে হয়তো কয়েকটা কচু গাছ।আমি বললাম, “কেন মামা, কচু গাছ তো দিব্যি দেখতে!
মামা চলে গেলে দিদি একটা বড় প্ল্যান নিল। আমাকে দায়িত্ব দিল, খেলতে যাওয়ার সময় কোয়ার্টারের সব বিল্ডিংগুলো দেখে আসতে। কোন কোন ফ্ল্যাটের বাইরে টব রাখা থাকে। আর কী কী ভাল গাছ পাওয়া যেতে পারে, একটা সরেজমিন তদন্ত সেরে আসতে হবে। আমি ওই অত্তো বড় কোয়ার্টারের সমস্ত বিল্ডিং ঘুরে একটা থিসিস তৈরী করলাম। পরিবেশবিদ, সমাজবিদ ও মনস্তাত্ত্বিকদের কাজে লাগত সেটা পেলে। ওই সোশিও-ইকনমিক ক্লাসে ওই সময় ঠিক কী ধরণের বাগান করত বাঙালি, তার সপ্রমাণ দলিল। তারপর চোট্টা ওয়াটসন এসে চোড়ুয়া শার্লক কে সমস্তটা জানালে শার্লক সিদ্ধান্ত নিল যে, টাইপ থ্রি ও ফোর এর ফ্ল্যাটগুলো বাদ দেওয়া হবে। কারণ ওগুলোতেই মায়ের কোলিগরা আছেন বেশির ভাগ। জানাজানি হয়ে গেলে... অতএব টাইপ ওয়ান ও টু-কে টার্গেট করা হল। এমনিও বেশ সুবিধে। বেশির ভাগ বিল্ডিং এর আড়ালে পড়ে গেছে এগুলো। চুরির সাক্ষী থাকার চান্স কম।
ক্রমে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কদিন ধরে নাগাড়ে পাওয়ার কাট চলছে। একবার গেলে তিন চার ঘন্টার আগে আর আলো আসে না। গরমে বিরক্তিতে জেরবার সবাই। আমার আর দিদিরই খালি আনচান ভাব, কখন হয় কখন হয়। অবশেষে হল। ঝুপ করে অন্ধকার। সঙ্গে সঙ্গে দিদির ফিসফিস, “বোনা চ’, এই সুযোগ! একটা কাপড়ের বড় ব্যাগ নিয়ে আমরা দু'জনে বেরিয়ে পড়লাম। সন্ধে তখন সাতটা কি আটটা হবে। বাবা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছিস! পাড়ারই কোনও বন্ধুর বাড়ি বলে বেরিয়ে পড়লাম দু'জনে। হনহন করে হেঁটে প্রথমেই চলে এলাম একটা বিল্ডিঙের ছাদে। আগের দিনই দেখে গিয়েছি... চমত্কা‌র বড় বড় জাপানি পাম। দুটো ঝেঁপে দিলেই কেল্লা ফতেহ্‌। ছাদে উঠেই তো সাড়ে সব্বোনাশ! কেউ একটা আছে! চুপি চুপি উঁকি দিয়ে দেখলাম, কে যেন আলসের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছে। চাঁদের মৃদু আলোয় চিনতেও পারলাম। উত্তমদা! খতরনাক লোক। কদিন আগেই পার্টিবাজি আর কমিটি নিয়ে ঝামেলা হয়েছে মায়ের সাথে! ধরা পড়লে আর রক্ষে নেই! চাপা গলায় দিদিকে বললাম, “পালাই! দিদিটা মহা নচ্ছার! বলে, “দাঁড়া না, দেখি কি করা যায়!
উত্তমদা আমাদের দিকে পিঠ করে বসে আছে। তাই আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। যে আলসেটার ওপর বসে আছে সেটার নিচেই টবগুলো সাজানো। কিন্তু আনতে গেলেই পায়ের শব্দে পেছনে ফিরবে, এমনকি আমরা ভয় পাওয়ার আগে ও-ই ভয় পেয়ে চেঁচাতে পারে! দিদিকে বললাম, “তুই এখানে দাঁড়া। আমি হামাগুড়ি দিয়ে টবটা নিয়ে আসি।এইবারেই হল মুশকিল। দিদির আর আমার একটা অত্যন্ত বদখত হাসির রোগ ছিল। একবার শুরু হলে আর থামত না। আর হেঁচকি উঠে যেত হাসতে হাসতে। সে নিয়ে ভয়াবহ সমস্ত গপ্পো আছে। দিদি দেখলাম সেই হাসিটা শুরু করেছে। আর ভয়ানক ছোঁয়াচে হওয়ায় আমিও মুহূর্তের মধ্যে হাসতে শুরু করে দিলাম। অন্ধকার ছাদ। কয়েক হাত দূরে বসে একটা লোক। দুরভিসন্ধি নিয়ে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দু'জনে হাসছি। হেসেই চলেছি। এবং নিঃশব্দে। পাছে উত্তমকুমার টের পান! ইদিকে ততক্ষণে লোকটার সিগারেট প্রায় আদ্ধেক হয়ে গেছে। শেষ হলেই কি জানি হয়তো নেমে আসবে! খানিক সামলে নিয়ে হামা দিয়ে ঢুকে পড়লাম ছাদে (আমি তখন ক্লাস এইট)টবটায় যখন হাত দিয়েছি তখন মাথার ওপর উত্তম। আমি নিচে অধমস্য-অধম হয়ে হাসি চেপে (পেটে প্রায় খিঁচ ধরে গেছে) টবটা গেঁড়িয়ে, ফেরতা হামা দিয়ে দরজায়। নিচে নামতে না নামতেই কারেন্ট এসে গেল। সামনের বিল্ডিঙের রান্নাঘর থেকে ঘোষ কাকিমা অবাক হয়ে দেখলেন হাসিদির মেয়েরা পাশের বিল্ডিং এর সিঁড়ি দিয়ে কেমন তরতর করে নেমে গেল...কাঁধে ভারী ঝোলা! নেমে এসে হাসিটা খানিক কন্টিনিউ করে য়্যাক দৌড়। ছুট্টে বাড়ি।
ঘরে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতেই দিদিকে শাসালাম, “ফের যদি খুদেকে গাছ দিয়েছিস”... দিদিও বলল, “নাঃ...অনেক হয়েছে...” বললে কি হবে! সত্যি বিশ্বাস করবে না। ক'দিনের মধ্যেই বর্ষা এসে গেল। তখন দিদি আমাকে সঙ্গে নিয়ে টাইপ থ্রি আর ফোরের সেই কোলিগধ্যুষিত বাড়িগুলো থেকে এক বারিষ মাথায় নিয়ে কিছু দামী ও শৌখিন গাছ গেঁড়িয়ে দিল।
খুদিমামার দোকান কদ্দিন চলেছিল জানি না। কারণ তার কিছুদিন পরই মামার বিয়ে হয়ে যায়। আর তারপর বুঝতেই পারছ, কোনও কন্সট্রাক্টিভ  কাজই কি আর করা সম্ভব?



দোয়েলপাখি  দাশগুপ্ত
১৯৯৬ 

10 comments: