আমাদের ইশকুলের উঠোনের প্রতিটি ইটে নিবেদিতার নাম খোদাই করা আছে। যখন জেনেছিলাম একথা, উঠোনে পা ফেলতে গা শিরশির করে উঠেছিল। যেন বইয়ে পা লেগে গেল। বা সরস্বতীর গায়ে। তারপর একদিন আলগোছেই দেখে ফেললাম সেই টেবিল, যেখানে নিবেদিতা বসে লেখাপড়া করতেন। সেই ঘর যেখানে একদিন তাঁর মৃত্যুর পর এসে সিস্টার ক্রিশ্চিন বসে বসে কেঁদেছিলেন অনেকক্ষণ। গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের সই, নিজের হাতের লেখাসমেত সিস্টারকে উপহার হিসেবে পাঠানো বিবেকানন্দের ছবি। সিস্টারের নিজের সংগ্রহের অসংখ্য আর্ট কালেকশন, পেইন্টিং, মূর্তি...! এই সেই মানুষ যিনি একইসঙ্গে ঠাকুরবাড়িরও প্রিয়, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে ওকাকুরা, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, অসিত সরকার প্রমুখ শিল্পী এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অসংখ্য ছাত্রনেতা ও বিপ্লবী যাঁকে শ্রদ্ধা করেন, মুগ্ধ হন। যাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করার কথা কেউ ভাবতে পারেন না। যাঁর জেদের কাছে হার মানেন সকলেই। উত্তর কলকাতার অনগ্রসর, রক্ষণশীল, জাতপাত মানা একটা এলাকায় অক্লান্ত পরিশ্রম আর উদ্যমে, সংকল্প আর দূরদর্শিতায় যিনি খুলে ফেলেন মেয়েদের ইশকুল। আর তাদের মায়েদের জন্যেও ‘শিল্পবিভাগ’ নামক একটি স্বনির্ভরতার প্রকল্প গড়ার কাজে ক্রিশ্চিনের মতো সহকারিণীকে উৎসাহ দেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী যোগাড় করেন। কেউ এগিয়ে আসছে না দেখে প্রচন্ড প্লেগের মধ্যে, প্রখর গরমে নিজেই নেমে পড়েন রাস্তা সাফাইয়ের কাজে। অথচ বাড়িতে বাড়িতে যাঁর ছায়া পড়লেও লোকে গিয়ে স্নান করে আসে!
এরকম একজন মানুষের নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত স্কুলে পড়েছি আমরা! একশ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যমন্ডিত এই স্কুলে পড়তে পারাটা আমাদের জন্য সৌভাগ্য তো বটেই, স্কুলকে নিজেদের মধ্যে কতটা বয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি, নিবেদিতাকে নিজেদর মনের মধ্যে কতটা ধারণ করতে পেরেছি সেটাই জানবার। আমরা ইতিহাসের শরিক। একটা যুগাবসান ও একটা নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে আমাদের সৃষ্টি। সেই ঐতিহাসিক সময়... যখন রামকৃষ্ণদেবের দেহাবসান হয়েছে অথচ পাছে তাঁর শূন্যতা মনোবল ভেঙে দেয় সদ্যপ্রতিষ্ঠিত মঠ ও মিশনের আবাসিক সন্ন্যাসীদের, তাই সারদামণি তাঁর দুহাতের অনন্তবালাদুটি খুলে ফেলছেন না। সাদা শাড়ির মোটা লাল পাড় ছিঁড়ে সরু করে পরছেন। আছেন আছেন! একই দাওয়ায় বসিয়ে নিজে হাতে খাওয়াচ্ছেন আইরিশ মেয়েটিকে। এখন ভাবলে কেমন লাগে? ঠিক এই সময়ে দাঁড়িয়ে? যখন দেশ জুড়ে শুধু অসহিষ্ণুতার হাওয়া! ধর্মের দোহাই! ওঁরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি প্রগতিশীল ছিলেন। ওঁরা মানে ওই দুই নারী। সারদামণি আর তাঁর ‘মেয়ে’ মিস মার্গারেট এলিজাবেথ নোব্ল। ২০১৭ সালের ২৮শে অক্টোবর তাঁর জন্মের সার্ধশতবার্ষিকী। তাই এই বছর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে উদযাপন। বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে তো বটেই, সিস্টারের নামাঙ্কিত ও স্মৃতিবিজড়িত বহু স্থানে, বহু শহরে... সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হচ্ছে উৎসব। এই উৎসবে সামিল হয়েছি আমরাও। রামকৃষ্ণ সারদা মিশন সিস্টার নিবেদিতা গার্লস' স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রীরা।
২০১২ সালে আত্মপ্রকাশ করেছিল আমাদের স্কুলের ফেসবুক গ্রুপ “আমাদের ইশকুল” -এর প্রথম ব্লগজিন “অপাঠ্য”। গ্রুপের বয়স তখন মাত্র এক। কিন্তু ওই এক বছরেই নস্টালজিয়া নিংড়ে বানানো সেই গ্রুপে তখন আমরা খুঁজে পেয়েছি আমাদের ফেলে আসা বন্ধু, সিনিয়র ও জুনিয়রদের। আলাপ হয়েছে আগে কখনও দেখা না হওয়া বহু দিদি ও বোনেদের সঙ্গে। একই শহরে বা দেশে কিংবা দূর দূর প্রবাসে খুঁজে নিয়েছে যে যার সহনাগরিক। সবাইকে খুঁজে পাওয়ার সেই আনন্দে ভাগ করে নিয়েছি, চেটেপুটে মেখে নিয়েছি আমাদের শৈশব, কৈশোর। সবাই মিলে হৈ হৈ করে খুব আনন্দের সঙ্গে এই ম্যাগাজিন প্রকাশের কাজটা করেছিলাম আমরা। তারপর মাঝে চার বছর কেটে গিয়েছে। আবারও নানান ব্যস্ততায় যে যার মতো দূরে সরে গিয়েছে। “অপাঠ্য” আর বেরোয়নি। এই কয়েক বছরে ইশকুলের উঠোনে এসে ভিড় করেছে আরও অনেক প্রাক্তনী। সব মিলিয়ে সংখ্যা এখন আঠারশ’রও একটু বেশি। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স কোথায় নেই তারা! এক একজনের এক একরকম টাইমজোন। তবু সারাদিন গ্রুপে পোস্ট পড়তে থাকে। ঘুম থেকে উঠে দেখি কত কত আড্ডা, আলোচনা হয়ে গিয়েছে... ছবি টাঙিয়েছে কেউ। কেউ প্রিয় দিদিদের নিয়ে বা স্কুলের হাজারো স্মৃতি নিয়ে কতকিছু লিখেছে! বড় সুন্দর সেইসব লেখা। আন্তরিক, মরমী। দূর দূর দেশে ছোট ছোট মিলনোৎসব করে ফেলেছে কেউ কেউ। এইসব লেখা আর ছবির মধ্যে চার বছর পর নতুন করে ফিরে এসে মনে হল, অপাঠ্যকে আবার ফিরিয়ে আনলে কেমন হয়? একটা চমৎকার সম্পাদকমন্ডলী তৈরি হয়েই ছিল, যাদের সঙ্গে সুন্দর বোঝাপড়া আছে এবং সহকর্মী হিসেবে কাজ করার সুখকর অভিজ্ঞতাও। তাই আবারও সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক হয়ে গেল, হ্যাঁ “অপাঠ্য” আবারও বের হবে। তবে এবার আর পয়লা বৈশাখ নয়। সিস্টারের জন্মদিনের দিন, ২৮শে অক্টোবর। আমরা কথা রেখেছি। সবার কাছে আজ নিয়ে এসেছি আমাদের “অপাঠ্যঃ দ্বিতীয় সংখ্যা”। একইসঙ্গে আমরা ঘোষণা করছি যে ২০১৭-র অপাঠ্য অর্থাৎ তৃতীয় সংখ্যাটি বিষয়ভিত্তিক হতে চলেছে এবং বিষয়ঃ সিস্টার নিবেদিতা এবং/অথবা তাঁর স্কুল। প্রাক্তনীদের লেখা ছাড়াও আমরা একটি বিভাগ রাখতে চাই, যেখানে নিবেদিতা ও স্কুলকে নিয়ে অন্যান্য জ্ঞানীগুণী মানুষদের রচনা প্রকাশ করা হবে। অতএব সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি, এই সংবাদটি ছড়িয়ে দিতে, যাতে বিভিন্নজনের লেখা পেতে আমাদের সুবিধে হয়। আমাদের লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ emag.amaderishkul@gmail.com
শেষে জানাই, অপাঠ্য-র আত্মপ্রকাশ সংখ্যার প্রিন্ট-আউট নিয়ে বাঁধিয়ে আমরা দিয়ে এসেছিলাম স্কুলে, এখনকার বড়দি, আমাদের মালাদি, প্রব্রাজিকা সত্যব্রতপ্রাণা মাতাজির হাতে। কী খুশি হয়েছেন তিনি সেই বই হাতে পেয়ে! স্বরূপাদি, ছোট অর্চনাদি, স্কুলের আরও যত দিদি উপস্থিত ছিলেন সেদিন, সকলে হাতে নিয়ে দেখেছেন আমাদের পত্রিকা। আশীর্বাদ করেছেন, আদর করেছেন। উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁদের সকলের এই আনন্দ আমাদের কাজে আরও উদ্দীপনা যুগিয়েছে। বহু ব্যস্ততার মধ্যেও চমৎকার সমস্ত লেখা জমা পড়েছে আমাদের ই-মেলে। চার বছরে আমরা বোধ হয় একটু বেশি পরিণত হয়েছি। এবারের লেখাগুলো তারই প্রমাণ। এদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই লেখা এসেছে সুদূর মেলবোর্ন থেকে... কোপেনহেগেন থেকেও। গল্প, ছবি, কবিতা, প্রবন্ধ, আত্মকথন, ভ্রমণকাহিনী, রান্নাবান্না সব মিলিয়ে একেবারে জমজমাট। সবাই খুশিমনে পড়, পড়াও, মেল-এ এবং সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার কর এই ব্লগজিন-এর লিঙ্ক। ছড়িয়ে পড়ুক উৎসবের আমেজ। সবাইকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানিয়ে...
-দোয়েলপাখি দাশগুপ্ত (১৯৯৬)
(গল্প ও অন্যান্য গদ্য বিভাগ এবং সামগ্রিক সম্পাদনা)
সম্পাদকমন্ডলীতে আরও যারা আছেঃ
ভ্রমণকাহিনী ও বিজ্ঞান বিভাগঃ ডালিয়া ঘোষ দস্তিদার (১৯৯৬)
কবিতা বিভাগঃ মন্দাক্রান্তা দাশগুপ্ত (২০০৪)
ছবি ও আঁকাজোকা বিভাগঃ পৌলমী সান্যাল (২০০৪)
সামগ্রিক প্রযুক্তিগত সম্পাদনাঃ প্রমিতা মৈত্র (২০০৮)
সহযোগিতাঃ
স্বাতী রায় (১৯৮৫)
No comments:
Post a Comment