স্মৃতির কোলাজে হলুদপাথর
"হলুদ পাথর যাচ্ছি কবে?" প্রশ্নটা শুনতে শুনতে কর্তা মনে হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে কুড়িয়ে বাড়িয়ে ৬টা দিন বার করা গেল। এবার আমার দায়িত্ব সস্তার ফ্লাইট টিকিট খোঁজার (যেহেতু তিন মাস আগেই কলকাতা ঘুরে আসা হয়েছে তাই বাজেট টাইট )। ভাগ্য ভালো সেটাও জোগাড় হল। এবার গন্তব্য ইউটা প্রদেশের অন্তর্গত সল্টলেক সিটি এয়ারপোর্ট, সেখান থেকে উত্তর আমেরিকার উত্তর-পশ্চিমে ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক অর্থাৎ আমার 'হলুদ পাথর'। মুখ্যত ওয়াইওমিন আইডাহ ও মন্টানা প্রদেশের কিছু অংশ নিয়ে এই পার্ক ১৮৭২ সালে স্থাপিত; বিস্তৃতি প্রায় ৩৫০০ বর্গমাইল, আর প্রবেশ পথও অনেকগুলো।
নির্দিষ্ট দিনে সল্টলেক সিটি পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকেই গাড়ি ভাড়া করা হল। সে রাতটা কাছেই একটা হোটেলে ইউটাতেই কাটালাম। পরের দিন বেশ সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। চালকের আসনে কর্তা, ম্যাপ হাতে পথ নির্দেশক আমি। বলাই বাহুল্য গাড়িতে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (সংক্ষেপে জি পি আর এস ) ছিল না। মাঝে বিশ্রাম এলাকায় লাঞ্চ সেরে নিলাম, তারপর ইন্টারস্টেট ১৫ ধরে চললাম হলুদ পাথরের উদ্দেশ্যে... ডিসকভারি চ্যানেলে দেখেই যেখানে যাবার বায়না ধরেছিলাম। ইউটা প্রদেশ ছাড়িয়ে এলাম আইডাহতে-
 |
আইডাহ ফলস |
দুপাশে পাহাড় কখনো দূরে আবার কখনো এগিয়ে এসেছে কাছে; পাহাড়ের পাদদেশে যতদূর চোখ যায় ভুট্টা আর আলুর ক্ষেত... মাঝে মাঝে কয়েকটা বাড়ি আর খামারবাড়ি। প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে গিয়ে এতই মোহিত হয়ে গেলাম যে পথনির্দেশ দিতেই গেলাম ভুলে - ড্রাইভারের হল পথ-ভুল আর আমার জুটল অল্প বকুনি। যাই হোক, আবার ঠিক পথে রওনা হলাম আমরা। পরিকল্পনামতো আইডাহ ফলস শহরে থামলাম কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার জন্য। ছোট্ট শহরের মধ্যভাগে রয়েছে আইডাহ ফলস যার উত্পত্তি স্নেক নদী থেকে। নদীর ধারে প্রায় ছয় মাইল বাঁধানো রাস্তা খুব সুন্দর করে সাজানো আর একপাশে ছোট্ট ফলস পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। দুপুর থেকেই এখানে স্থানীয় লোকেদের খুব ভিড় দেখলাম। কেউ এসেছে জগিং করতে, কেউ আবার কুকুরকে হাঁটাতে... বাচ্চারা হাঁসেদের খাওয়াতে ব্যস্ত। ফলসকে সামনে রেখে একটু দূরেই রয়েছে আইডাহ ফলস মর্মন মন্দির। মর্মন সম্প্রদায় খ্রিষ্টান হলেও এদের ধর্মাচরণে কিছু পার্থক্য রয়েছে। মন্দিরে মর্মন সম্প্রদায় বহির্ভূত লোকদের প্রবেশ নিষেধ। সমগ্র ইউটা আর আইডাহ জুড়েই মর্মনদের বাস, আর রয়েছে অসংখ্য মন্দির। শহর থেকেই অনেক দূরের রকি পর্বতমালার গ্র্যান্ড টিটন শাখাটি দেখা যায়। বৈকালিক চা আর স্ন্যাক্স খেয়ে আবার যাত্রা শুরু... লক্ষ্য ওয়েস্ট ইয়েলোস্টোন শহর। পার্কের পশ্চিম প্রবেশ পথটি এখানেই।
এখানে একটু বলে নেওয়া যাক এই ন্যাশনাল পার্ক সম্বন্ধে। প্রকৃতি তার ভান্ডার ঢেলে দিয়েছে এখানে। জঙ্গল, নদী, নদীখাত, পাহাড়শ্রেণী, হ্রদ - কী নেই এখানে! রয়েছে বিভিন্ন প্রাণী... এল্ক, মুজ, কায়টি, গ্রিজলি বিয়ার, উলফ, বাইসন। বৃহত্তর ইয়েলোস্টোন হল পৃথিবীর অন্যতম অক্ষত বাস্তুসংস্থান (ইকোসিস্টেম)। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য এখানে যান্ত্রিক প্রযুক্তি ও উন্নয়নের দ্বার প্রায় রুদ্ধ বললেই চলে, কাজেই মোবাইল ফোন, টেলিভিশন এসবের কোনো ব্যবহার নেই। সম্পূর্ণ পার্কটাই একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি অঞ্চল যেখানে দেখা যায় ১০,০০০ এর বেশি ভূ-তাপীয় বিশেষত্ব। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে আছে গিজার বেসিন,উষ্ণ প্রস্রবণ (hot spring), মাড পট (mud pot), বাষ্প নিকাশী ভেন্ট(fumarole)।
 |
ম্যাডিসন ভ্যালি |
প্রায় সন্ধ্যা হবার মুখে ঢুকে পড়লাম পার্কে। প্রথমেই ম্যাডিসন ভ্যালি, ক্যামেরা নিয়ে নেমে পড়লাম দুজনে। সামনেই ম্যাডিসন নদী। নদীর অন্যপারে একদঙ্গল এল্ক(বড় হরিণ) জল খেতে এসেছে... চারদিকে জঙ্গল, গোধূলির আলো ছড়িয়ে আছে, সব মিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর এক দৃশ্য। মন জয় করে নিল ইয়েলোস্টোন। কাছাকাছি আরেকটা আগ্নেয় বেসিনও গেলাম। এই বেসিনগুলোর নিচে রয়েছে ম্যাগমা, মাটির নিচের জল এই ম্যাগমার সংস্পর্শে এসে ফুটতে থাকে... তারপর জল আর বাষ্প প্রচন্ড চাপে মাটির অপরের ছোট ছোট গর্ত দিয়ে বেরিয়ে এসে আগ্নেয়গিরির মত ওপরের দিকে উঠে যায়; একেই বলে গিজার। এরকম কয়েকটা গিজার আর বাষ্পনিকাশী দেখে আমরা গেলাম গ্র্যান্ট ভিলেজে। এখানে আমাদের দু'দিন থাকার পরিকল্পনা করাই ছিল। জায়গাটা ইয়েলোস্টোন হ্রদের পাশেই দক্ষিণ-পশ্চিমে। আমাদের রুম থেকেই হ্রদ দেখা যাওয়ার কথা, যদিও রাতের অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলাম না।
পরের দিন ভোর না হতেই উঠে পড়লাম, ইচ্ছে বিয়ার বা উলফ -এর সঙ্গে মোলাকাত (শুনেছিলাম এই সময়েই ওরা জল খেতে আসে লেকে) আর ওয়েস্ট থাম্ব বেসিনে সূর্যোদয় দেখা। প্রথম ইচ্ছেটা যদিও পূর্ণ হয়নি, ভিলেজ ক্যাফেটেরিযাটি চমত্কার, হ্রদের ঠিক পাশেই। হিমবাহ সৃষ্ট এই হ্রদ প্রায় ২০ মাইল লম্বা এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্বত্য হ্রদ, প্রাতরাশ সেরে সেদিন গেলাম মাড ভলক্যানো দেখতে... দেখলাম এখানে রয়েছে অনেক মাড পড, যেখানে গরম জল আর বাষ্প তৈরী করেছে বড় বড় গর্ত যার মধ্যে গরম কাদা ফুটছে... চারপাশে সালফার আর হাইড্রজেন সালফাইড-এর গন্ধ। পরের গন্তব্য হেডেন ভ্যালি... বাইসনদের প্রিয় জায়গা। এখানে দেখলাম দলে দলে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফাররা বসে আছে ক্যামেরা চোখে রেখে, বেশ কিছু দূরে হাজারেরও বেশি বাইসন দল বেঁধে চলেছে... এই দৃশ্য যে না দেখেছে তাকে বোঝানো যায় না।
দুপুরবেলা নাকে মুখে দুটো গুঁজে দে দৌড়। না না, পায়ে নয়,গাড়িতেই! ওল্ড ফেইথফুল গিজার...
 |
ওল্ড ফেইথফুল গিজার |
ঘড়ি ধরে এক থেকে দেড় ঘন্টা পর পর জল ও বাষ্প বের হয় ফোয়ারার মত এই গিজার থেকে... আমরা যখন পৌঁছালাম তখনও ১৫ মিনিট বাকি, পাশেই ওল্ড ফেইথফুল লজ কাফে থেকে চা নিয়ে এসে বসলাম। ঠিক সময়মতো জেগে উঠল গিজার... প্রথমে ধীরে ধীরে তারপর দ্রুত বের হতে লাগল বাষ্প ও গরম জল; উচ্চতা প্রায় ১৭০ ফুট! ৫ মিনিট পর থেমে গেল সব। আবার অপেক্ষা... অনেকেই রয়ে গেল আরেকবার দেখার জন্য, আমরা ফিরে এলাম সারাদিনের ক্লান্তি আর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে।
পরের দিন চলে এলাম ক্যানিয়ন ভিলেজে। আমাদের কেবিনের ঠিক পেছনেই ঘন জঙ্গল। মনে আশা জাগল রাতে হয়তো এখানেই বিয়ার আর নেকড়ের দেখা পাব।
সকালেই গেলাম ইয়েলোস্টোন নদীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে। হ্রদ থেকে সৃষ্ট এই নদী কত হাজার বছর ধরে তৈরি করেছে ১২০০ ফুট গভীর এই ক্যানিয়ন। এখানে রয়েছে আপার ও লোয়ার দুটো ফলস। লামার ভ্যালি জায়গাটা আবার গ্রে উলফদের বেশ পছন্দের। কপাল ঠুকে রওনা হলাম যদি তাদের দেখা পাই, সেখানে খানিক ট্রেকও করা হল কিন্তু দেখা মিলল না তাদের। এখানেই আলাপ হল এক আমেরিকান দম্পতির সঙ্গে। ভারতীয় দেখে আলাপ করতে এলেন, কলকাতার শুনে মহিলা বড়ই খুশি হলেন এবং আমাদের অবাক করে দিয়ে ঝরঝরে বাংলায় কথা শুরু করলেন! জানা গেল ওনার ছোটবেলার অনেকটাই কেটেছে কলকাতায়। ফেরার পথে দেখা হল গুটিকয় মুজ (এক প্রকার বড় হরিণ) আর ছানা সমেত কায়োটির (প্রেইরি উলফও বলা হয় এদের) সাথে। বিকেলে ব্ল্যাক স্যান্ড বেসিন দেখতে গেলাম, এখানে রয়েছে অনেক বর্ণময় হট স্প্রিং যার অন্যতম এমারেল্ড পুল। বিভিন্ন শৈবাল (algae) আর গরম জলে বাস করা ব্যাকটেরিয়ারাই এই রঙ তৈরি করেছে।
 |
এমারেল্ড পুল |
এদিন রাতে কর্তা বেরোলেন ক্যাফেটেরিয়া থেকে খাবার আনতে। ফিরতে দেরি হচ্ছে, মোবাইল সংযোগও নেই, অগত্যা আমিও বেরোলাম। দরজা খুলে সবে বেরিয়েছি; চাঁদের আলোয় সামনেই দেখলাম কালো আর বেশ বড় মত কী একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি তো খুব উত্তেজিত ও আনন্দিত... ভেবেই নিলাম গ্রিজলি বিয়ার দেখছি। তবে সাহস করে কাছে গেলাম না, ফিরে এলাম ঘরেই। দু' মিনিটের মাথায় দরজায় নক; কর্তা ফিরলেন এবং আমার আনন্দে দিলেন জল ঢেলে... শুনলাম কেবিনের বাইরে একটা দলছুট বাইসন ঘুরছে। নাহ্ এ যাত্রা আর দেখা হল না! ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
চতুর্থ দিনটা পার্ক থেকে বেরিয়ে পাশেই গ্র্যান্ড টিটন পার্ক আর আশপাশের শহর ঘুরে একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম ক্যানিয়ন ভিলেজে। কর্তা গিন্নী দুজনেই কদিন টই টই করে ক্লান্ত। পঞ্চম দিনের প্ল্যানও তৈরিই আছে... নরিস বেসিনও অন্যান্য বেসিনগুলোর মতই বিভিন্ন ভূ-তাপীয় বিশেষত্বযুক্ত। এখানে নতুন যে ঘটনাটা ঘটল সেটা হল দু'জনেই নিজের নিজের ক্যামেরায় ছবি তুলতে তুলতে গেলাম হারিয়ে। বেশ বড় বেসিন, মোবাইল অচল... ঝাড়া একটি ঘণ্টা পর পরস্পরকে খুঁজে পেলাম।
 |
ম্যামথ হট স্প্রিং |
ম্যামথ হট স্প্রিংও বেশ বর্ণময়; এর অনেকগুলো ভাগ। একটি অংশের নাম প্যালেট স্প্রিং- সার্থকনামা ; ঠিক যেন কোনো শিল্পী তার প্যালেটে মিশিয়ে রেখেছে সাদা, কমলা, সবুজ রঙ... এখানেও শিল্পী সেই ব্যাকটেরিয়া। দেখার কোনও শেষ নেই কিন্তু পরের দিন খুব সকালে বেরোতে হবে। তাই বিকেলের আগেই ফিরে এলাম কেবিনে। গোছগাছ করে জলদি ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম। হলুদপাথরকে কিছুটা চেনার তৃপ্তি আর বেশিটাই না দেখার অতৃপ্তি - এই মিশ্র অনুভূতি নিয়ে কেটে গেল শেষ বিনিদ্র রজনী।
শ্রীপর্ণা বসু
১৯৯২
এই লেখাটা আমার সত্যি খুব ভালো লেগেছে, প্রথমত তো আমি এই 'হলুদপাথর' নাম টা প্রথম শুনলাম, আর জায়গাগুলোর সম্বন্ধে পড়তে পড়তে আর স্পেশালি ছবিগুলো দেখে ভীষণভাবে ইচ্ছে হচ্ছিল চলে যাই। যাইহোক, সেটা তো আপাতত হচ্ছে না, তাই তোমার গপ্পই ভরসা শ্রীপর্ণা দি...
ReplyDeletedarun!!
ReplyDeleteJhhoejhhore lekha,khutinati biboron-o khub sahaj o sundor kore uposthapito.:)Lekhonir guney jete boroi ichchhe korchhe, Sutorang lekhika, abar jabar plan kor eksathe.
ReplyDeletechol pathika...plan kor kobe jabi...
DeletePromita, Ishani, Mrittika ...jaygata sotyi khub sundor re, chhobite ar koto tukui ba dhora gechhe...
ReplyDelete