হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে!



জানালার ধারে আনমনে বসে ছিল সে। সারা সকাল ধরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়েছে। দুপুরেও তার রেশ ছিল। এখন শেষ বেলায় এসে ক্ষান্ত দিয়েছে। রাস্তাগুলো, তাদের বেড় দিয়ে থাকা গাছগুলো সব ভিজে ভিজে ঝকঝকে, তরতাজা হয়ে উঠেছে। বেতের দোলনার কুশনের হাল্কা ছোঁয়া গায়ে মেখে অনেকক্ষণ বাদে মেঘ ফুঁড়ে বেরনো সূর্যের আলোয় নিজেকে সেঁকে নিচ্ছিল নীপা । হঠাৎ “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে”- র সুর শুনে চটকা ভাঙল। মোবাইলে হোয়াটস-আপের নোটিফিকেশান-এর সুর। একটু অলস কৌতূহলে হাতে তুলে নিল মুঠোফোন। অপুর বার্তা। চোখ বুলাতে গিয়ে কিন্তু চমকে উঠল। ভারি অদ্ভুত কথা লিখে পাঠিয়েছে অপু। "Making a friend is easy but maintaining friendship for lifetime needs high level of emotional intelligence. Happy friendship day”. আশ্চর্য তো! বন্ধুত্ব বজায় রাখতে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স লাগে? বড় চিন্তায় পড়ে গেল নীপা। কোলের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে আছে দিউ, নীপার সাধের পোষা কুকুর। নাঃ অভিজাত কোন কুকুর নয়, নেহাতই পাড়ার নেড়ি কুকুর। তবু নীপার আদরে আদরে বেশ চকচকে। আর বড্ড আদরখেকো। সব সময় কোলটি জুড়ে বসে থাকে। তবে নীপার তাতে বিশেষ আপত্তি নেই। ওকে নিয়েই তো দিন কাটে। মাঝ চল্লিশের আগেই হঠাৎ স্বামী মারা গেলে, একমাত্র সন্তান বিদেশে থাকে যে মহিলার, তার সময় কাটাতে একটা কিছু তো লাগে। তাও যদি নীপা মিশুকে হতো, তাহলেও হয়তো প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করে খানিক সময় কাটাতে পারত। কিন্তু নীপার বর বলত যে পৃথিবীতে যদি কে কত বড় ঘরকুনো তার প্রতিযোগিতা হতো, তাতে নীপা নির্ঘাত প্রথম হতো। তাই নীপার পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে গল্পের দৌড় “কেমন আছেন? ভালো তো?” আর একটু মৃদু হাসির বাইরে এগোয়নি। তাই নীপার সঙ্গী বলতে দিউ। আর আছে অপু।


অপু। অপর্ণা সেন। ছোট বেলায় এই নামের জন্যে কত ঠাট্টা শুনতে হয়েছে বেচারিকে। “হি হি ! তুই কি ফিল্ম ডাইরেক্ট করিস নাকি?” কেন জানি না এটা শুনলেই অপুর ফর্সা মুখটা গনগনে লাল হয়ে উঠত। কতই বা বয়স তখন ওদের? সাত-আট হবে বড়জোর । মনে ভেসে এল সাদা ফ্রক আর লাল ফিতের গন্ডিতে মোড়া আহ্লাদী মুখগুলোর কথা। প্রাইমারি সেকশনের ছোট ছোট ঘরের মধ্যে এঁটে উঠত না ওদের কলকাকলি। কিন্তু ঘর উপচে সিঁড়ি বেয়ে যেই সেই হট্টগোল গিয়ে নীচের বড়দির ঘর ছুঁত, অমনি সবাই কেমন যেন রে রে করে ছুটে আসত। মেয়েগুলোর খুশিভরা মুখগুলো কেমন চুপসে যেত। তবে আবার দু’ মিনিটের মধ্যে বকুনির রেশ ভুলে যেতেও আটকাত না। আবার কোনও না কোনও কথার রেশ ধরে এ ওর গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়ত। তখন, যতদূর মনে পড়ে, অত বন্ধু-অবন্ধুর বাছবিচারও ছিল না। আজকের দিনের মত মা-ব্রিগেড ছিল না, কে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে সেটা ঠিক করে দেওয়ার জন্যে। তাই যখনই যার পাশে বসা, তখনই তার সঙ্গে গলায়-গলায়।


তারপর বয়স গড়াল। প্রাইমারি থেকে সেকেন্ডারি আসতে গিয়ে কখন যেন তাদের শৈশবটা টিকটিকির ল্যাজের মতো খসে পড়ল। স্কুলের ব্যাগের ভার বাড়ল। বাড়ল পড়ার চাপ। এই সন্ধিক্ষণেই নীপা আবিষ্কার করল যে বন্ধুত্ব ব্যাপারটাও আর “হাত বাড়ালেই বন্ধু”-র মতো সহজ নেই। ক্লাসের চল্লিশ জনকে দেখে মুখে যে হাসি ফোটে, তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ হচ্ছে বিশেষ দু-একজনকে দেখলে। কেন সেটা বোঝার ক্ষমতা ছিল না সেদিনের দ্বাদশী নীপার। তবে অনেক পরে যখন পড়েছে “A friend is a second half”,তখন মনটা বলে উঠেছে “ঠিক ঠিক”। আসলে যে আকাশে নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে মেলে দেওয়া যায়, কোনও রাখঢাক না রেখেই, তেমন একটি আকাশই শুধু খুঁজে এসেছে নীপা। আর সেই প্রাক-যৌবনের দিনে অপু তাকে দিয়েছিল এমন আকাশ। দুটি জীবনের প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি মুহূর্ত ছড়িয়ে ছিল দুজনের সামনে। তারা একসঙ্গে হাসত, একসঙ্গে কাঁদত, একসঙ্গে রাগত। ভাবতেই পারত না একে অন্যকে ছেড়ে জীবন হতে পারে। 


ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস টুয়েলভ অনেকটা পথ। অপুর হাত ধরে অনায়াসে পেরিয়েছে সেই পথ। দুজনের মিল ছিল কতটা? উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ির মেয়ে নীপা। ওদের বাড়ির মেয়েরা সূর্যের আলো দেখবেন না বলে পাল্কি শুদ্ধু নদীতে ডুব দিয়ে গঙ্গা স্নান করতেন। এখন অবশ্য ওদের উঠোনে সূর্যের আলো ঢোকে। তবু মা-ঠাকুমাদের আলোর থেকে আঁধার বেশি পছন্দের। নরম-স্বভাবের নীপার মনে যতই প্রশ্ন উঠুক, সে জানত সেই সব প্রশ্ন বাড়িতে তোলা যাবে না। যখন ক্লাস এইটে পড়ে, তখন মুখ ফসকে বলে উঠেছিল একবার। সেবার শিবরাত্রির দিনে নীপা ও নীপার দাদার খুব পছন্দের বিরিয়ানি হয়েছে। নীপার উপোষ সেদিন, দাদা নীপাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বিরিয়ানি খাচ্ছে আর ওর পিছনে লাগছে। সেদিন নীপা একটু জোর দিয়েই বলেছিল, কী হবে এই সব উপোষ করে? আমি আজ বিরিয়ানি খাব। ব্যাস! বাড়িতে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। মা- ঠাকুমা -পিসঠাকুমা সবাই হাঁ হাঁ করে উঠেছিলেন। শিব ঠাকুরের মাথায় জল না ঢাললে যখন বিয়ে হবে না, তখন কে ওই বিরিয়ানি খাওয়াবে? আর দাদা খাচ্ছে তো, তোমার কী? তুমি আর দাদা কি এক? বুড়োধাড়ি মেয়ে। মাথায় কোনও বুদ্ধি হল না! এই সাত-সতের কথার মধ্যিখানে নীপার বিরিয়ানি খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছিল। সত্যিই তো সব কিছুতেই মাঝারি মাপের এই মেয়েটির কী করেই বা এত সাহস হয় যে সে মুখ তুলে কথা বলে!


অপু ছিল সব দিক দিয়েই আলাদা। তখন সদ্য গড়ে ওঠা লবণহ্রদের থেকে সে পাড়ি দিত উত্তর-কলকাতার ওই স্কুলে। ইঞ্জিনিয়ার বাবা আর স্কুল-শিক্ষিকা মায়ের একমাত্র সন্তান সে। বাবা-মা তাকে নিয়মের বেড়ি না পরিয়ে তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিয়ম-ভাঙ্গার চাবিকাঠি। তাকে পড়তে শিখিয়েছিলেন। আর তাকে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। রোগা ছিপছিপে অপু যখন জ্বলজ্বলে মুখ নিয়ে সুতীব্র যুক্তিতে ডিবেটের আসর মাতাত, তখন নীপার বুকটা গর্বে ভরে যেত। প্রাইজ দেওয়ার দিনে অনেক অনেক প্রাইজ নিয়ে অপু এসে নীপার হাতে সেগুলো জমা করে দিয়ে আবার চলে যেত স্কুলের গানের দলে গান গাইতে। নীপা প্রাইজগুলোর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে মুগ্ধ হয়ে শুনত অপুর রেওয়াজি গলায় গাওয়া প্রার্থনা মন্ত্র। তীব্র বিবেকবোধযুক্ত অপু ভয় পেত না সত্যি কথা বলতে। মিথ্যের সঙ্গে আপোষহীন, স্টিলের মেরুদণ্ড-অলা অপুকে নীপা এক অর্থে প্রায় পুজো করত। 


স্কুল ছাড়ার পরে অপু চলে গেল হোস্টেলে, ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে। নীপাও ভর্তি হল বটে কলেজে। কিন্তু সবাই জানে যে এটা হল তার ওয়েটিং স্টেশন। স্কুল-জীবন আর সংসার-জীবনের মাঝখানে সাময়িক বিরতি মাত্র। এবং বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সানাই বাজিয়ে অশোক দত্তের গলায় মালা পরিয়ে নীপা বদলি হল এক বনেদি বাড়ি থেকে আরেক বনেদিতর শ্বশুরবাড়িতে। বিয়েতে অপুও এসেছিল বইকি। সতেজ লতার মতো, শুধুমাত্র বুদ্ধির সাজে উজ্জ্বল অপুকে দেখে নীপার মনে হয়েছিল এই বেনারসি আর গয়নার খাঁচা খুলে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু সব কিছু কি সবাই করে উঠতে পারে?


তারপর জীবনসংগ্রাম। সংসারজীবন। ঠিক আর দশটা মেয়ের মতো। ভালয় মন্দয় মিশিয়ে সুক্তোর মতন। শুধু অপু কখনো ওর শ্বশুরবাড়িতে আসেনি। আসলে বিয়ের ঠিক পরেই নীপার শ্বশুরবাড়িতে অপুকে নিয়ে কিছু আলোচনা হয়। নতুন বৌ এর বন্ধু! বন্ধুর বিয়েতে এসেছে অথচ একটাও গয়না নেই গায়ে! বেনে বাড়ির চোখে এ ভারি হাস্যকর দৃশ্য। কিছু বাঁকা মন্তব্য শোনার পরে নীপাই অপুকে বারণ করে দেয়। “আসিস না। যারা তোর কদর করতে পারে না, তাদের কাছে আসিস না”। অপুর স্কলারশিপের পয়সায় কেনা হলুদ রঙের বিভূতি রচনাবলীর জায়গা হয়েছে তার জামা-কাপড়ের আলমারির ফাঁকে। এ বাড়ির বউদের হাতে বিভূতিভূষণ ভারি বেমানান। দুপুরে খেয়ে উঠে গড়ানোর সময় একটা দুটো আনন্দলোক বা সানন্দার পাতা উল্টানো অবধি ঠিক আছে। 


নীপার জীবন যদি গরুর গাড়ির তালে চলে, অপু এগিয়েছে রকেটের বেগে। এদেশ থেকে মাস্টার্স শেষ করে ও বিদেশে গিয়ে ডক্টরেট করে। তারপর ফিরে এসে এখানেই অধ্যাপনা। নীপার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল চিরকালই। আগে চিঠি লিখে, তারপর যখন ও দেশে ফিরে এল, তারপর থেকে ফোন। মাঝেসাঝে দেখাও হত, সংসারের হাজারটা খুঁটিনাটি সামলে নীপা যখন বেরোতে পারত, তখন। অপুকে কিন্তু কখনও সংসারের দোহাই দিতে শোনেনি। অথচ কর্পোরেটের বড় কর্তা স্বামী আর ছোট ছেলেকে নিয়ে তারও ভরাট সংসার। তবু তার নীপার জন্যে সময় থেকেছে, বরাবর। শুধু সময়ই নয়, নীপার ছোটখাট শখ আহ্লাদও মেটানোর দায়িত্ব অপুর। কোথায় কোন নতুন লেখকের নতুন লেখা বেরোচ্ছে, নীপাকে কে-ই বা এনে দেবে অপু ছাড়া? আবার অন্য দিকে নীপার এমব্রয়ডারি করা ব্লাউজ ছাড়া শ্রীঅঙ্গে তুলতে পারে না অপু। অপুর বর নির্মলের এসবে কোনও আপত্তিই নেই, বরং সে ওদের বন্ধুত্বটা খুব উপভোগ করে। নীপা কিন্তু অশোকের কাছে কিছুতেই বলে উঠতে পারে না অপুর গল্প। ওর খালি মনে হয় অশোক যদি ঠিক বুঝতে না পারে অপুর সঙ্গে ওর মনের টানের গভীরতা, যদি ওদের বন্ধুত্ব নিয়ে ঠাট্টা করে ওঠে! তার থেকে গোপনই থাক ওদের কথা। সব কিছুকে আলোর সামনে মেলে ধরতে হবে এমন কী কথা আছে!


নীপার জীবনে যেদিন মহা দুর্যোগ এল, তখনও পাশে থেকেছে শুধু অপু । হঠাৎ করে একদিন অশোকের চলে যাওয়া। আর তারপরেই নীপাকে ঘিরে তৈরি হল একটি প্রায় নিয়মের জেলখানা। অপুই নীপাকে সেই হাজারো নিষেধের গন্ডি ভেঙ্গে বের করেছে। একটু একটু করে সময় দিয়ে ওকে সাহস যুগিয়েছে যে নিজেকে নিয়েই বাঁচা যায়, নিজের জন্যেও বাঁচা যায়। অপুর জন্যেই নীপা ভাশুরদের আদেশ অমান্য করে রঙ্গিন শাড়ি পরতে পেরেছে। অপুই নীপার জাদের মুখ হাঁ করিয়ে নীপার মুখে চিকেন কাটলেট গুঁজে দিয়ে বলেছে, ভজহরির চিকেন কাটলেট না খেলেই পাপ হয়। তাই তো নীপা যেদিন পড়েছিল যে “A friend is a second self”, ওর বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি। খালি একটু দুঃখ হয়েছিল তাদের কথা ভেবে যাদের জীবনে এমন বন্ধু আসে না। 


অপুই জোর করে অনেক অনেক বছরের পরে ওকে নিয়ে গিয়েছিল স্কুলের বন্ধুদের গেট-টুগেদারে। অপুরই ব্যবস্থাপনায় জমায়েত। নীপা আসবে না তা তো হতেই পারে না। এক ঝাঁক মাঝবয়েসি মহিলা মিলে উচ্চকিত স্বরে হাহাহিহি করছিল। মাঝে মাঝে একজন বলে উঠছিল “এই আস্তে আস্তে! নাহলে এবার এখান থেকে উঠিয়ে দেবে”- একটু সবাই সংযত হচ্ছিল, কিন্তু সে আর কতক্ষণের! আবার শুরু হচ্ছিল হাসির লহরা। একেক সময় মনে হচ্ছিল এ যেন শপিং মলের রেস্টুরেন্ট নয়, সেই ছোটবেলাকার ক্লাসঘর! শুধু বড়দির ধমকাতে ধমকাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসাটুকুরই অপেক্ষা! চিরকালের মুখচোরা, কথা-বলতে-না-পারা নীপা হট্টগোলে বিশেষ একটা অংশ না নিলেও, ভালোই লাগছিল এতদিন পরে সেই পুরনো মুখগুলো দেখে। বড় একটা ঝাঁকের কথা হচ্ছিল স্বামীর চাকরি, বিদেশভ্রমণ, ছেলে মেয়ের অসামান্য মেধা এই সব নিয়ে। বড় বেশি চকচকে, প্রসাধনরঞ্জিত মুখ এদের। স্বামী-সন্তানের প্রতিভার প্রতিফলিত বিভায় উজ্জ্বল। নীপার নিজেকে বড্ড বেমানান লাগে এর মাঝখানে। অশোকের বেঁচে থাকার সময়ও সে অশোকের চাকরির উন্নতিকে নিজের উন্নতি বলে ভাবতে পারেনি। খুশি হয়েছে- কিন্তু ওই অবধিই। ছেলেকে মন দিয়ে পড়িয়েছে। কিন্তু তার রেজাল্টের কৃতিত্ব দাবী করতে পারেনি। বা ছেলের আমেরিকান নামী ইউনিভারসিটিতে ৮০% এরও বেশি স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার কথা নিজের মুখে বলেও বেড়াতে পারে না। তার সাদামাটা প্রসাধনহীন চেহারা বোধহয় এই দলের বাকিদের সঙ্গে যায়ও না। তবু অপু এদের মধ্যে রয়েছে বলে, সেও এখানে এসে জুটেছিল। অপু না জানি কেমন করে এদের সঙ্গেই ছেঁদো গল্প করছিল। কিছুক্ষণ পরে আর অর্থহীন কথা হজম করতে না পেরে, নীপা মুখ ঘোরায় যেখানে মনীষা, নিবেদিতা এদের ছোট একটা দল গুলতানি মারছে। মনীষা একটা এন জি ও চালায়। আর নিবেদিতা বিয়ের পরেও ওর কর্পোরেশনের স্কুলের চাকরিটা ছাড়েনি। ওদের গল্পগুলো শুনতে শুনতে নীপার মনে হচ্ছিল আহা যদি ওদের মতো হতে পারত! মনীষাকে বলেই ফেলল, নিবি আমাকে তোদের সঙ্গে কাজ করতে? ঠিকানা ফোন নম্বর আদানপ্রদানও করে নিল। বেশ চলছিল। ছন্দপতন হল বেরনোর ঠিক আগে। ঈপ্সিতা অনেকক্ষণ ধরেই বরের গৌরবে ছলছল হয়ে বাড়ি, গাড়ি, নতুন কেনা আই- ফোন, আগের গরমেই ঘুরে আসা নর্দার্ন ইউরোপের গল্প করছিল। সত্যি কথা বলতে নর্থ ইউরোপের কথা শুনে নীপা প্রথমটা খুব মন দিয়েই গল্প শুনছিল। কিন্তু খানিকক্ষণ ধরে শুধু কোন শহরে কোন ডিজাইনার শপ আছে আর কোথায় কোন সেক্স শপ থেকে সে কী কিনেছে সে গল্প শোনার পরে খানিকটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করেছিল, “হ্যাঁ রে, অ্যামস্টার্ডামের মেরিটাইম মিউজিয়মে যাসনি?” ঈপ্সিতা ততোধিক অবাক হয়ে বলেছিল, “শুধু শুধু মিউজিয়াম দেখে সময় নষ্ট করব কেন?”এর পর আর কথা বাড়ায়নি নীপা। আর তারপরেই সে মনীষাদের সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ঈপ্সিতার বোধহয় মানে লেগেছিল। তাই বেরনোর আগে সে অকারণেই মনীষাকে গায়ে পড়ে উপদেশ দেয় “চুলগুলো একেবারে সাদা হয়ে গেছে। রং করালেও তো পারিস। রাস্তায় দেখা হলে লোকে তো বিশ্বাসও করবে না যে আমি তোর ক্লাসমেট। না হয় একটা ফোন করে আমার বাড়ি চলে আসিস। আমার হেয়ার কালারিস্টকে বাড়িতে ডেকে এনে ওকে দিয়ে করিয়ে দেবখন”। মনীষা হেসে বলে, “আমার চুল আমারই থাক ভাই। তুই বরং রাস্তার লোককে বলিস, আমি তোর বন্ধুর মা”। ঈপ্সিতা আরও রেগে গিয়ে তার এককালের প্রাণের বন্ধু মনীষাকে বলে, “তাহলে এবার থেকে তুই ওই নীপা-টিপাদের মত থার্ড ক্লাস লোকদের সঙ্গেই মিশিস - যেমন থার্ড ক্লাস চেহারা করছিস!” তারপর তো হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। একদল ঈপ্সিতার পক্ষে আর এক দল স্বভাবতই তার বিপক্ষে। অপুই শেষকালে সবাইকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বাড়ি পাঠাল। “সত্যিই তো নীপাটা একেবারে থার্ড ক্লাস! কেমন সব সময় রামগরুড়ের ছানার মত মুখ করে থাকে, আমারই ওকে মাসিমা বলতে ইচ্ছে করে”। বলতে বলতে মনীষাদের লিফটে তুলে দিল। “ঈপ্সিতা এক কাজ করি, চল তুই আর আমি একদিন তোর পার্লারে যাই। তারপরে একদিন নীপা তাকে নিয়ে যাব আমি, দেখব তো চুলের রং পাল্টালে ওর মুখেও একটু হাসি ফোটে কিনা”। এইসব আবোল তাবোল কথার মাঝখানে দ্বিতীয় লিফট এসে ঈপ্সিতাদের সবান্ধবে নিয়ে চলে গেল। লিফটের খাঁচার ঠিক সামনে তখন শুধু অপু আর নীপা। একটু অপ্রস্তুতের হাসি হেসে অপু বলে, “যা কেলো হচ্ছিল আর একটু হলে। আরে ঈপ্সিতা হল নির্মলের নতুন অফিসের বসের বৌ। এর আগের এক পার্টিতে ওর সঙ্গে দেখা হল। ও বলেছিল বলেই এই গেট-টুগেদারটার ব্যবস্থা করেছিলাম। আর তাকে তুই দিচ্ছিলি একেবারে ঝুলিয়ে! কী দরকার ছিল তোর ওকে মিউজিয়ামের কথা জিজ্জেস করার? যাক তাও কোন রকমে ম্যানেজ করা গেছে। উফফ! কী বাজেই না বকতে পারে! সারাক্ষণ খালি নতুন কী কিনল আর কোন দামি রেস্তোরাঁয় খেল আর কোন ফ্যাশনেবল জায়গাতে বেড়াতে গেল! শুনে শুনে মাথা ধরে গেল! চল চল, বাড়ি যাই”। নীপার গলার কাছে একটা দলা মতো আটকে গেল- “তুই তাহলে বরের বসের বৌকে খুশি করার জন্যে আমাকে থার্ড ক্লাস বললি? যতই হেসে হেসে বল, বললি তো!আর তার চেয়েও বড় কথা তুই, যে তুই আমাকে শিখিয়েছিস সব রকমের লোভের উপরে উঠে নিজের বিশ্বাসে অবিচল থাকতে, কোনও ছলনা না করতে, কোনও মুখোশের আড়াল না নিতে, সেই তুই কিনা ইপ্সিতাকে পছন্দ না করেও ওকে গোটা সন্ধে ধরে তেল মেরে গেলি!" কথাটা অবশ্য মনেই থেকে গেল। মুখ দিয়ে বেরোল না। বরং সে মনে মনে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে লাগল এই মনে-মুখে-আলাদা অপুকে সে চেনে কিনা। ভাবল, এই অপুই কি তার দ্বিতীয় সত্ত্বা? 


তারপরে ক’দিন কেটে গেছে। আজ ফ্রেন্ডশিপ ডে। অপুর পাঠানো মেসেজ হাতে নিয়ে বসে নীপা ভাবছে, অপুর কাছে বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটা কবে থেকে বদলে গেল? হৃদয়ের ভাষার জায়গা কবে নিল মস্তিষ্কের কুশলী হিসাব? আরও জরুরি হল, নীপা এখন কী করবে? অপুকে চিরকালের মত আনফ্রেন্ড করে দেবে তার জীবন থেকে? এই পাল্টে যাওয়া অপুকে তার প্রয়োজন নেই কোনও... শুধু নিজের বিশ্বাসে অবিচল হয়ে, অপুর শেখানো ছলনাহীনতার মন্ত্রের উপর ভর করে বাকি জীবনটা একলাই বাঁচবে? ছেলে যখন ফোন করে জানতে চাইবে, “মা তোমার মুখে আর অপুমাসির নাম শুনি না কেন?” তখন হেসে হেসে বলবে “বুঝলি, বন্ধু বলে আসলে কিছু হয় না। একটা মানুষ কি ভলডেমারট নাকি তার সত্ত্বার অংশ অন্যের মধ্যেও থাকবে?” নাকি নীপা নিজেকে মানিয়ে নেবে এই হিসাব-কষা ভালবাসায়? জানবে যদিও তার উড়ে বেড়ানোর খোলা আকাশটা আর নেই! তবু সেই জানাটাকে টুঁটি টিপে ধরে, মৌখিক বন্ধুতার হৃদয়হীন শুকনো উচ্ছ্বাসে ভরা মেসেজ পাঠাবে অপুকে “হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে!” 


ভাবছে, নীপা ভেবেই চলেছে!



স্বাতী রায়
১৯৮৫

4 comments:

  1. ইশকুলের উঠোনে দাঁড়িয়ে এরকম লেখা কতটা প্রাসঙ্গিক নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝি। "মৌখিক বন্ধুতার হৃদয়হীন শুকনো উচ্ছ্বাসে ভরা মেসেজ" কম পাইনি কেউই আমরা। :)
    তার মধ্যে থেকেই যে কজন মণিমুক্তো জুটেছে, তারা অপ্রত্যাশিতভাবে আবার ভুলিয়ে দিতে পেরেছে এই না পাওয়াদের।

    ReplyDelete