শোক



বাড়ির এই দিকটায় তেমন লোকজনের বাস নেই। সিঁড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ডানদিকে তাকালে একটা সিমেন্টবাঁধানো চাতাল পড়ে। সেখানে একটা আধভাঙা টিউবওয়েলের তলার দিকের খাড়া অংশটা জেগে আছে। তার ওপরের হাতির শুঁড়টা ভেঙে গেছে কবেই! একপাশে একটা টালির চালের ঘর, তার ইটগুলো পলেস্তারা-খসা, ঘরের ভেতরে সাতরাজ্যির শুকনো নারকেলপাতা আর কাঠকুটো জড়ো করা। এককোণে একটা কাঠের উনুনও রয়েছে। এসব দেখতে দেখতেই প্রমীলার চোখ পড়ল পেঁপেগাছটার দিকে। লিকলিকে সরু গাছ, নি-নি করছে চাট্টি কালচে খয়েরি ছোপ ধরা সবজেটে পাতা, ফলটলের বালাই নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাছটার তলায় দাঁড়াতেই হঠাৎ গন্ধটা ভেসে এল। কীরম যেন আতপচালের ভাত ফুটে ওঠার মতো একটা হাপুসহুপুস গন্ধ, কিংবা একবলক দুধে একমুঠো গোবিন্দভোগ চাল ফেলে অন্নকূটের পরমান্ন রাঁধা হচ্ছে যেন! ঠিক যেন মার রান্না পায়েস! গন্ধের ঝিমঝিমে ভাবটা মাথার মধ্যে তখনও ভালো করে চারিয়ে যায়নি, এমন সময় সিঁড়ির তলা থেকে করুণাপিসির চিৎকার---"দেখে যাও গো, ও বড়োবউ, সব কলা ভামে খেয়ে গেল বুঝি!" কি হল ব্যাপারটা দেখবেন বলে এগিয়ে এসে দেখলেন, সিঁড়ির নীচটায় একটা ছোট্ট ভিড় জমে গেছে। সেখানে করুণাপিসি, বুড়ি শাশুড়ি, ছোটো জা আর মেজো জা মিলে দাঁড়িয়ে। সামনে কয়েকটা নিপুণ হাতে খোসা ছাড়িয়ে আধখাওয়া করে ছড়িয়ে রাখা মর্তমান কলা। প্রমীলার অজান্তেই একটা ছোট্ট শ্বাস পড়ল। এইজন্যেই তাহলে আতপচালের গন্ধ বেরোচ্ছিল! এ নিশ্চয় গন্ধগোকুলের কাজ! আর তিনি কি না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়েসের গন্ধ ভাবছিলেন! সকাল সকাল এসব আজেবাজে ভাবনা মোটে পছন্দ না তাঁর। কিন্তু গেল হপ্তায় সিউড়ির বাড়ি যাওয়ার পর থেকেই বারবার প্রমীলার মনটা উথালপাথাল করে উঠছে। 

প্রমীলার বাপের বাড়ি সিউড়িতে। যাওয়া হয় অবরে-সবরে। তিন বছরে এক কি দুইবার। বাপ-মা বেঁচে থাকতে যাও বা একটু পুজোর সময় কি জামাইষষ্ঠীতে যাওয়া হত, এখন ওসব পাট চুকে গেছে কবেই। ছেলেপুলেরাও বড়ো হয়েছে, তাদের ইস্কুল, কলেজ, আপিস, কাছারি, সকালের ভাত, টিফিনের লুচি, খাতার মলাট, জ্বরের ওষুধ---এই করেই কেটে গেছে কতদিন। কবে যে শহরতলির এই বিশাল বাড়িটার মধ্যে কোন্‌ অতলে তলিয়ে গেছে সিউড়ির সেই শ্যামবর্ণ কিশোরীটির অবাক ছেলেবেলা, কে রেখেছে তার খোঁজ? তবু অঘটন ঘটল। গত সপ্তাহে প্রমীলাকে যেতে হয়েছিল সিউড়িতে। দাদার ছেলেটা বহুদিন পর দেশে ফিরছে, এসে সিউড়ির বাড়িতেও থাকতে চায় দু-দিন। যে বাড়িতে তার ছেলেবেলাটা ছবি হয়ে ধরা আছে দাদুর বই, দিদুনের পান, পিপির ফিতেবাঁধা বিনুনি, মায়ের গন্ধতেল আর বাপির ঘড়ির সঙ্গে, সেই বাড়িটায়। সঙ্গে চাই তার আদরের পিপিকে। পিপি ছাড়া আর কে-ই বা আছে তার এ দেশে? তা পিপি গেছিলেন বই কী! পিপি-ভাইপো মিলে কটাদিন খুঁটে খাওয়া যাবে স্মৃতির মোহময়ী নির্যাস---এ কথাই ভেবেছিলেন মনে মনে। কার্যক্ষেত্রে অবশ্য যা ঘটেছে, তাতে স্মৃতি রোমন্থন করাটাই প্রমীলার কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছে জগদ্দল পাথরের মতো ভারী একটা কাজ!

শনিবার দুপুরে স্টেশনে নেমে, হাতভরতি মালপত্তর টুবানের ঘাড়ে চাপিয়ে হাঁচোড়পাঁচোড় করে যখন রিকশা চড়ছিলেন, তখনও ভাবেননি, তাঁর জন্য এত বড়ো একটা ধাক্কা অপেক্ষা করে থাকবে! বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকে লাল মেঝের ওপরে সবে পা ফেলেছেন, এমন সময়ে দোতলার বারান্দার সবুজ রেলিঙের ফাঁক থেকে তাঁকে দেখতে পেয়ে লাফাতে লাফাতে নীচে নেমে এল পুপান---" আরিব্বাস পিপি! কী মোটা হয়েছিস রে তুই! হ্যাঁ রে টুবান, মা কি একাই তোদের ন-জনের সব বরাদ্দ খেয়ে ফেলছে নাকি রে?" লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে ভাইপোর কানটা মুলে দিতে যাবেন, হঠাৎ চোখ পড়ল বারান্দার দরজায়। আড়ালে দাঁড়িয়ে একটি অপরিচিত মুখকে হাসতে দেখে থেমে গেলেন প্রমীলা। তাঁর থমকে যাওয়া দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকিয়ে পুপান বলল, " চিনতে পারছিস না? ও তো ছোটন! এখন একটা কলেজে পড়ায়। আজ সকালেই এখানে এসেছে আমার আসার খবর পেয়ে!" "ছোটন! তুই! বাপ রে! চিনব কী করে বল তো? এত মোটা গোঁফ রেখেছিস, এত বড়ো চশমা পরেছিস!"---গালে হাত দিয়ে বলেন প্রমীলা। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা ছোটনের চিবুক ছুঁইয়ে চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করেন, "বেঁচে থাকো বাবা! সুখী হও!" বুকের ভেতরে একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে যেতে থাকে তাঁর। মনে পড়ে যায়, এই ছোটনের ঠাকুমার সঙ্গেই তাঁর মায়ের কী আশ্চর্য এক সখ্য ছিল! শেষ বয়সে বিধবা হওয়ার পর মা বড়ো শক পেয়েছিলেন। মার এক অদ্ভুত ধারণা ছিল, বাবা চলে গেলে তিনি আর বাঁচবেন না। সতীত্ব, সিঁদুরের জোর, স্বামীর পরমায়ু এবং বৈধব্য---এক আশ্চর্য জটিলতা তৈরি করেছিল মায়ের মনে। তাই বাবার মৃত্যুটা মায়ের কাছে যতটা না কষ্টের, তার চেয়ে ঢের বেশি লজ্জার ছিল বলে আজও প্রমীলার স্থির বিশ্বাস। ভারী স্বামীসোহাগিনী ছিলেন মা। সে-কথা এখন বুঝতে পারেন প্রমীলা। ডগডগে করে সিঁদুর পরতেন সিঁথি জুড়ে, হাতে মোটা সোনার বালা, লালপেড়ে শাড়িই ছিল সবসময়ের পছন্দ, সারাদিন সংসারের উনকুট্টি কাজের মধ্যেও বাবার ভাতের থালা সাজানো, জামা গোছানো, কলমে কালি ভরে রাখা----সব করতেন নিজের হাতে। সন্ধেবেলায় দুজন মিলে পা ছড়িয়ে তক্তপোশে বসে সুখদুঃখের গল্প করছেন---এ ছবি আজও প্রমীলার চোখে স্পষ্ট। সেই বাবাই যখন চলে গেলেন, মা পড়লেন অথই জলে। বাবার চলে যাওয়াটাকে নিজের দোষ বলেই ঠাউরেছিলেন মা। সেই সময়ে এই ছোটনের ঠাকুমা ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথা বলতেন না তিনি। মুখ ঘুরিয়ে থাকতেন। ছেলেমেয়ে কেঁদে পড়ত পায়ের কাছে। ভ্রূক্ষেপও ছিল না। তখন তো বিয়ে হয়ে গেছে প্রমীলার। তাও দমদম থেকে ছুটে ছুটে আসতেন মায়ের কাছে। কিন্তু মা তো তাঁকে দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নিতেন। কী আর করবেন তিনি? ওই ছোটনের ঠাকুমার ভরসাতেই থাকা। সে-সময়ে অদ্ভুত একটা পাড়াতুতো গুজব কানে এসেছিল তাঁর। ছোটনের ঠাকুমার সঙ্গে নাকি তাঁর বাবার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। পাড়ার কোন্‌ এক জ্যোতিষী হাত দেখে বৈধব্যযোগের কথা বলায় বিয়ে ভেস্তে যায়। তা তাঁর মায়ের পয়ে সে-যাত্রা বাবার প্রাণটি বেঁচে যায়। 

ছোটনকে দেখে হঠাৎ সেসব কথা ভিড় করে এল মনের মধ্যে। ভাল করে ভেবে দেখলেন তিনি, কখনও বাবাকে ছোটনের ঠাকুমার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছেন বলে মনে পড়ল না। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। পাড়াতুতো সম্পর্ক। কাজে-অকাজে এ বাড়ি-ও বাড়ি যাতায়াত, বিজয়ার প্রণাম, দোলের ন্যাড়াপোড়া---সবেতেই সবাই ছিল একসঙ্গে। কিন্তু বাবা আর সমুকাকিমা যে কথা বলতেন না নিজেদের মধ্যে, সে-কথাটা কোনোদিন তিনি ভেবেই দেখেননি! একটু অস্বস্তি হচ্ছিল প্রমীলার। এসব কী ভাবতে বসলেন তিনি! "বোস তোরা, আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি"---বলে ওপরে এলেন তিনি। দোতলাটা একদম এক রকম রয়ে গেছে আজও। ওই তো ঠাকুরঘরের হলুদ মোজেইক করা মেঝের ওপর সবুজ পাথরের ছককাটা, মাঝের হলঘরে মোটা কাচের ঝাড়লন্ঠন দুলছে টুংটাং শব্দে, মায়ের ঘরটায় সেই পুরনো কাঠের গন্ধ। প্রমীলা হালকা পায়ে এগোলেন মায়ের ঘরটার দিকে। বিছানায় টানটান করে আকাশি রঙের চাদর পাতা। বিছানাটার ওপর বসে আলতো হাতে মুঠো করে ধরলেন চাদরটা। এই বিছানাটায় শুয়ে মা মারা গিয়েছিলেন। রাত্তিরে ঘুমের মধ্যে। কেউ বুঝতে পারেনি। সকালে সমুকাকিমার চেঁচামেচিতে জানতে পারে সবাই। প্রমীলা আসতে পারেননি সেই সময়ে। টুবান জন্মাল তার ঠিক পরদিন। মা মারা যাওয়ার আট মাস পর যখন বাপের বাড়িতে পা রেখেছিলেন, তখন মনে হয়েছিল, কোথাও একটা মস্ত বড়ো ভুল হয়ে গেছে। মাকে খবর দিয়ে আসা হয়নি। তা নইলে মাকে ঠিক পাওয়া যেত। আট মাসের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে পাগলের মতো প্রায়ই এ-ঘর-ও-ঘর পায়চারি করতেন তিনি। কেউ শান্ত করতে পারত না তখন। শেষ সময়ে মাকে একবারও দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণাটা সহ্য করতে পারেননি প্রমীলা। নানান কথা মনে পড়ছিল তাঁর। আরও কতক্ষণ বসে বসে এসব ভাবনা চলত কে জানে, হঠাৎ ছোটন এসে দাঁড়াতে ছিঁড়ে গেল চিন্তার জালটা---"মিলুপিসি, ঠাকুমা মারা গেছে গতবছর, খবর পেয়েছিলে?"

---ঠাকুমা? মারা গেছেন? সে কী? কী করে ছোটন?

---ওই বয়স হয়েছিল। চোখে দেখত না তো ভালো। শেষটা প্রায় অন্ধ হয়েই কাটিয়েছে জান? তা এই অবস্থায় বাথরুমে পড়ে গিয়েছিল একদিন, আর উঠতে পারল না। বেডসোর হয়ে গিয়েছিল সারা পিঠে। খুব কষ্ট পেয়েছে গো শেষটায়। যাক গে, বাদ দাও ওসব কথা। তোমার জন্য একটা জিনিস দিয়ে গেছিল ঠাকুমা। তোমাকে দেওয়া হয়নি কোনওদিন। যদি কিছু মনে না কর তো দিয়ে দিতে পারি।

---আমার জন্য! কী?

এবার আর মুখে কিছু বলে না ছোটন। চুপচাপ জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা রুমালে মোড়া কী যেন বার করে প্রমীলার হাতে দেয়। খুলে প্রমীলার চক্ষু ছানাবড়া। এ কী! এ তো মায়ের লোহা-বাঁধানো! এটা কী করে সমুর ঠাকুমার কাছে গেল? জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই শুকনো হাসি খেলে যায় ছোটনের মুখে---"রাঙাদাদু মারা যাওয়ার পর ঠাম্মার কাছে এগুলো রাখতে দিয়েছিলেন রাঙাদিদা। বলেছিলেন, যতদিন বেঁচে আছেন, ততদিন যেন এগুলো ঠাম্মার কাছেই থাকে।" হতভম্ব হয়ে যান প্রমীলা। মানেটা কী? মা কি তাঁর বৈধব্যে বিশ্বাস করতেন না? নাকি সমুকাকিমার ভাগ্যদোষে বাবার মৃত্যু হতে পারত জেনে একদিন যে ভাঁওতার অংশ হিসেবে মায়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাবার আয়ুরক্ষা করা হয়েছিল, শেষবয়সে তার অসারত্বের সামনে দাঁড়িয়ে মা কি এতটাই বেসামাল হয়ে পড়েছিলেন? কী ভাবছিলে তুমি মা? বাবাকে নিজের জোরে বেঁধে রাখতে পারনি? সমুকাকিমা হলে ঠিক পারত? 


বাড়ি ফিরেও ভাবনাটা কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছিলেন না প্রমীলা। একবার ভাবলেন, দাদাকে একটা ফোন করে বলা যাক। পরক্ষণেই মনে হল, বউদিকে আড়াল করে দাদাকে এসব কথা বলা যাবে না। এখন থাক। পরে বলা যাবে। বাবা আর মায়ের মাঝখানে সমুকাকিমাকে দাঁড় করিয়ে সবার সামনে হাজির করতে পারবেন না প্রমীলা। তাঁর বাবা-মায়ের দাম্পত্য নিয়ে কেউ কোনও কথা বললে তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়াটা মুশকিল হবে। হাজার হোক, বউদি তো আর মায়ের কোলে, বাবার হাতে মানুষ হয়নি! বাবা-মাকে জাজ করার অধিকার ওর নেই। এইসব সাতপাঁচ ভাবতেই ভাবতেই দুধ থেকে সর তুলে, চিনি ছড়িয়ে ভাঁজ করে রাখছিলেন প্রমীলা, হঠাৎ হু-হু করে কান্না পেল তাঁর। সেই কোন্‌ ছোটোবেলা থেকে মায়ের গলার গান না হলে ঘুম আসত না, বাবার কাছে না বসলে অঙ্ক মিলত না ছোট্ট মিলুর, আর আজ? বাবা নেই, মা নেই, মাঝখান থেকে বাবা-মা-সমুকাকিমা মিলে এ কী বিচ্ছিরি গোলকধাঁধায় পড়লেন তিনি? আলমারি খুলে মায়ের লোহা-বাঁধানোটা বার করে হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক করে দেখতে থাকেন প্রমীলা। কী যেন ভাবতে ভাবতে একসময় সেটা হাতে গলিয়েও ফেলেন তিনি। কাকপক্ষীতেও কিছু টের পায় না। সন্ধে নাগাদ মেজো জা শুধু একবার ছোটো জাকে চোখ টেপে---"দেখছিস ছোটো, বুড়ির সাজটা একবার শুধু দ্যাখ! বয়সের তো নেই গাছপাথর, আবার বাপের বাড়ি থেকে নতুন চুড়ি আমদানি করে পরা হয়েছে! হুঁঃ! ঢং!" শাশুড়ি একবার জিজ্ঞেস করেন, "চুড়ি কোথায় পেলে বউমা?"

--- এটা মায়ের চুড়ি মা। মায়ের আলমারি থেকে নিয়ে পরলাম। মা খুব ভালোবাসতেন এই চুড়িটা। বাবার দেওয়া ছিল তো!

---সেই তো মা! ঘরের মানুষটা চলে গেলে সে যে কী কষ্ট বাছা! তুমি বুঝবে না। তোমার মা বুঝেছিলেন।


ভালো করে খেয়াল করে শাশুড়ির কথাটা আর-একবার শোনেন প্রমীলা। "তুমি বুঝবে না।" যেন, বোঝাটা খুব জরুরি ছিল। ঠিক যেভাবে নতুন বিয়ের পরপর সংসারের কোনো হিসেবপত্তর গুলিয়ে ফেলে শাশুড়ির কাছে গেলে, ভ্যাবাচ্যাকা নতুন বউকে অনুকম্পার স্বরে সংসারের গরবে গরবিনী শাশুড়ি বলতেন, "ওসব তুমি এখন বুঝবে না!" অবিকল সেই এক সুর! সেই এক দার্ঢ্য! আচ্ছা, বৈধব্যের কি কোনো অহংকার থাকে? এমন এক অভিজ্ঞতার শরিক হওয়ার অহংকার, যে অভিজ্ঞতা নারীর একান্ত নিজস্ব? তাও সব নারী পায় না এ যন্ত্রণার আস্বাদ। কটু স্বাদ আস্বাদন করতে করতে একসময় স্বাদের তীব্রতা মগজকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, স্বাভাবিক স্বাদের আকাঙ্ক্ষার চেয়েও তখন বড়ো হয়ে ওঠে সেই তীব্রতা সহ্য করতে পারার আশ্চর্য ক্ষমতা যে নিজের মধ্যে লুকিয়ে ছিল এতদিন, সেই উপলব্ধির বিস্ময়। বাবার অসুস্থতার সময়ে মাও তো বারবার বলতেন, "তোর বাবা চলে গেলে আর থাকব না। মিলিয়ে নিস।" তখন প্রমীলা কাঁদতেন হয়তো, ভবিতব্যের নিষ্ঠুরতায় শিউরে উঠে মাকে ধমকাতেনও কখনও কখনও, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, এই কথাটা ঘুরিয়েফিরিয়ে বলে মা কি আসলে নিজে নিজেই সবার অলক্ষে একা একা বেঁচে থাকার শক্তি সংগ্রহ করছিলেন? একটা প্রায় অবশ্যম্ভাবী পরিস্থিতির কথা বারবার উচ্চারণ করে করে তার তীব্রতাকে সইয়ে নিতে চেয়েছিলেন? বৈধব্যকে ভারি গ্লানিকর বলে মনে করতেন মা। আর সেজন্যেই বোধহয় সেই গ্লানি আর যন্ত্রণা সহ্য করেও বেঁচে থাকার মধ্যে যে অকল্পনীয় সহ্যশক্তির সন্ধান পেয়েছিলেন, তাতে নিজেই অবাক হয়ে পড়েছিলেন। বাকি জীবনটা জুড়ে সেই বিস্ময়ের ঘোর বুঝি আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি।


কী মনে হতে একবার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে বসেন প্রমীলা, "আচ্ছা মা, বাবা চলে যাওয়ার পর আপনার একদিনও ইচ্ছে করেনি লালপাড় শাড়ি পরতে? গয়না পরতে? সত্যি করে বলুন দেখি?" প্রমীলার দুঃসাহস দেখে খানিক স্তম্ভিত হয়ে শাশুড়ি বলেন, "এসব ঢঙের কথা আর কখনও উচ্চারণ করতে এসো না আমার সামনে। কাজে যাও। যত্তসব!" এইবার প্রমীলা হেসে ফেলেন। নাঃ! তিনি তাঁর প্রশ্নের জবাবটা পেয়ে গেছেন। বৈধব্যের মধ্যে নয়, দার্ঢ্যটা রয়েছে বৈধব্যপালনের আড়ম্বরের মধ্যে। মা বাবাকে ছেড়ে বাঁচতে পারতেন না, এ কথা হয়তো সত্যি নয়। তবে স্বাভাবিকভাবে যে পারতেন না, এ কথা সত্যি। মায়ের মনের তেমন জোর ছিল না। সেজন্যেই ওই আচার, বিচার, সাদা শাড়ি, খালি হাত, হবিষ্যি, একাদশী---এগুলোকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন শেষদিকে। এর মধ্যে দিয়ে ওই 'গ্লানি'টা মেটাতেন বোধহয়। আর সমুকাকিমা? মায়ের চিরকালীন করুণার পাত্রী। তাই বাবা চলে যাওয়ার পর সমুকাকিমাকে বাবার দেওয়া লোহা-বাঁধানো উপহার দিয়েছিলেন মা। এমন মর্মান্তিক উপহার কে কাকে দিতে পারে? প্রিয় মানুষটার মৃত্যুতে একজন নিজের যাবতীয় পার্থিব সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে কৃচ্ছ্পালনের মধ্যে দিয়ে অন্তত তার শোক উদ্‌যাপনের একটা রাস্তা যখন খুঁজে পাচ্ছে, তখন অন্য আর-একজনকে উপহার দেওয়া হচ্ছে তারই ফেলে দেওয়া, বাতিল, অপ্রযোজ্য সোহাগচিহ্ন! এই শোকে যে তার বিন্দুমাত্রও অধিকার নেই, তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে তীব্রভাবে। মা কি সমুকাকিমাকে করুণা করার অধিকারের মধ্যে দিয়েই বাবার অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন নিজের কাছে? আস্তে আস্তে একটা একটা করে জট ছাড়াতে থাকেন প্রমীলা। তাঁর মুখে লেগে থাকে মৃদু হাসির লেশ। না, সমুকাকিমা কোনওদিন আসতে পারেননি তাঁর বাবা-মায়ের মাঝে। মায়ের শোকের জাঁক আর জমকের কাছে সমুকাকিমা নেহাতই অকিঞ্চিৎকর দর্শকমাত্র, সে শোককে স্পর্শ করার সাধ্য ছিল না কারও। এমনকি, প্রমীলারও না। তাই ছোটনের হাত থেকে এ চুড়ি ফেরত পেয়ে তিনি এত কিছু ভেবেছেন। মাকে নিয়ে। বাবাকে নিয়ে। সমুকাকিমাকে নিয়ে। বাবাকে আর মাকে নিয়ে। বাবাকে আর সমুকাকিমাকে নিয়ে। মাকে আর সমুকাকিমাকে নিয়ে। বাবা, মা আর সমুকাকিমাকে নিয়ে। আসল কথাটা হল, কেউ কোত্থাও নেই। একা রয়ে গেছে মায়ের জ্বলজ্বলে শোকটা। আর কেউ নেই। কিচ্ছু নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রমীলা বলেন, "একটু চা করে দিই মা? আপনার ছেলে এনেছে। দার্জিলিং চা। "



অরুন্ধতী দাস
২০০৭ 

12 comments:

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  2. প্রথম যখন গল্পটা পড়েছিলাম, শুধু লেখার চলন এবং বিষয়ের গভীরতাই মন কেড়ে নেয়নি, সঙ্গে এই কথাটাও মনে হয়েছিল যে কত কম বয়সে এই লেখাটা লিখতে পেরেছে অরুন্ধতী। কড়া ফেমিনিজম নেই, আটপৌরে স্নিগ্ধতা... তেল-হলুদ আঁচলে মাখামাখি এ-লেখায়। চেনা চরিত্রদের ভেতরমহলের অলিগলি উঠে আসে এই লেখায়। ওর আগামীর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. This comment has been removed by the author.

      Delete
  3. ভাষার বাঁধুনি চোখে পড়ার মতো। স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। অনেক শুভেচ্ছা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. This comment has been removed by the author.

      Delete
  4. Bhison saboleel bhasai lekha.khub bhalo laglo pore..

    ReplyDelete
    Replies
    1. This comment has been removed by the author.

      Delete
  5. khub bhalo laglo lekhata pore.

    ReplyDelete
  6. থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ!

    ReplyDelete
  7. Lekhatae kmn maer acholer nun tel holud moshla meshano gondho.. mn ta chuye galo alto kore..

    ReplyDelete
  8. apathya pora ei suru korlam. ei lekhata pore chomke gelam, ami sotyi eto bhalo lekha expect korini.

    ReplyDelete
  9. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete