তুমলিং






কদিন আগে সাধ হল, ট্রেকিং-এ যাব। আগে কখনও যাইনি, কোনও প্রশিক্ষণও নেই, কিন্তু ধিঙ্গিপনা তো আছে। আর কোনও গ্রহ-নক্ষত্রর অস্থান-কুস্থানে অবস্থানের ফলস্বরূপই বোধহয়, সেটা বেড়েও চলেছে বয়েসের সাথে। পিতৃদেব শোনামাত্রই নেতিবাচক জবাব দিয়েছিলেন। তবে কি জানেন তো,যদি ধিঙ্গিপনা অন্তরের অন্তস্হল থেকে উঠে আসে, তাহলে সেই “অল দি ইউনিভার্স কন্সপায়ার্স ইন হেল্পিং ইউ" কেস হয়ে যায় আর কী। আরও তিন বান্ধবীও জুটে গেল। সকলেরই প্রথমবার। ফেসবুক-এ একজন উদ্যোক্তাকে পেয়েছিলাম, যিনি এইধরনের বিগিনারস’ ট্রেক উৎসাহ সহকারে বন্দোবস্ত করে দেন। তিনি একজন সদ্য কলেজ পেরনো পাহাড়প্রেমী যুবককে সঙ্গে দিলেন গাইড হিসেবে। অফিসে একপ্রস্থ ‘ইসে-ইয়ে-ইত্যাদি' বলে ছুটি আদায় করে রাত ১০টার দার্জিলিং মেল-এ চেপে শান্তি... পরদিন নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে জিপ ধরে সোজা মানেভঞ্জন (৭০৫৪ফুট), মোটামুটিভাবে চারঘন্টার রাস্তা। এখান থেকে আমাদের গন্তব্যস্থল তুমলিং (৯৬০০ফুট) প্রায় ১৩ কিমি। মানেভঞ্জনের পরের যাত্রাপথ মোবাইল নেটওয়ার্ক রহিত। সব্বাই চটপট আগামী তিনদিন যে অজ্ঞাতবাস হতে চলেছে সেটা বাড়িতে জানিয়ে দিলাম। ঠান্ডা লাগা থেকে বাঁচতে কেউ যদি ব্র্যান্ডি ইত্যাদি কিনতে চান, তাহলে এখান থেকেই কিনে নিতে হবে। মানেভঞ্জন থেকে ল্যান্ডরোভার-এর ইঞ্জিনবিশিষ্ট ট্রেকারই ভরসা। পাথুরে রাস্তায় আর অন্য গাড়ি চলে না। একে একে চিত্রে রামধুরা পার হয়ে গেলাম। চিত্রে পেরোতেই ঠান্ডা বেড়ে গেল হু-হু করে। উৎসুক আগ্রহে অপেক্ষা করছি কখন পৌছব। তমোঘ্ন (আমাদের গাইড) বলল, “দিদিরা, আজ আমরা একটু হালকা ট্রেক করব। এই ৩ কিমি মতো। “বটেইতো। ট্রেকই তো করতে এসেছি। প্রবল উৎসাহে হাঁটা শুরু করলাম। খানিক পরে একটু হাঁফ ধরল, উৎসাহের প্রাবল্য একটু কমল। এক গাল হেসে তমোঘ্নকে জিজ্ঞেস করলাম, “অনেকটাই এসে পড়েছি, বল”। সে ততোধিক মিষ্টি হেসে জবাব দিল, “এই তো সবে ৮০০-৯০০ মিটার হল দিদি।" বোঝ কান্ড! 

মেঘ-পাহাড়

তুমলিং পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বিকেল চারটে বাজল। তমোঘ্ন অবশ্য উৎসাহ দিল যে প্রথম দিন হিসেবে পারফরমেন্স মোটেই খারাপ নয়। থাকার ব্যবস্থা হোমস্টে। সন্ধে কাটল গল্প-গুজবে। রাত্রি হতেই কম্বল-টম্বল জড়িয়ে “হিহি-হুহু"। ঠিক হল পরদিন সকাল চারটেয় উঠে টংলু (১০,০০০ফুট) ট্রেক। 

সন্দকফু যাবার রাস্তা 


টংলুতে সূর্যোদয় দেখা হবে। অ্যালার্ম ঘড়ি যথাসময়ে বেজেছিল। কিন্তু চোখ খুলতে খুলতে বেলা ৭ টা। আমরা ঠিক করলাম যে আজকে অল্পস্বল্প ঘোরাঘুরি আর অনেক-অনেক ছবি তোলা। পাশেই নেপাল বর্ডার। বর্ডার পেরোতেই ফোন বেজে উঠল। কিন্তু, ইন্টারন্যাশনাল রোমিং। একটু এগিয়ে সন্দকফু যাওয়ার রাস্তা। বেশ কিছু ট্রেকের গ্রুপের সঙ্গে দেখা হল যারা সন্দকফু চলেছে। ফিরতে ফিরতে বেলা ২ টো। ততক্ষণে মেঘের মোলায়েম আস্তরণ ঢেকে ফেলছে পাহাড়। 

শায়িত-বুদ্ধ 

সন্ধেবেলা সে কী পা ব্যথা। এদিকে একটু ভদকাও পড়েছে পেটে, ফলত মনের ব্যথাও চাগিয়ে উঠেছে কম-বেশি। সব মিলিয়ে সন্ধেটা ‘বিন্দাস’। পরদিন ভোর ভোর উঠে পড়লাম। আজকে প্রায় ১০ কিমি হাঁটার কথা। প্রথমে টংলু। আকাশ পরিস্কার থাকলে ওখান থেকে খুব সুন্দর স্লিপিং বুদ্ধ দেখা যায়। জন্য, কোকতং, কাবরু, কাঞ্চনজঙ্ঘা, শিম্ভ, পান্ডিম ইত্যাদি পর্বতশৃঙ্গ মিলে শায়িত বুদ্ধের অবয়ব। 


তুমলিং থেকে টংলু একটানা খাড়াই। এরপর উৎরাই। আমরা যাব মেঘমা হয়ে চিত্রের দিকে। চিত্রে থেকে মানেভঞ্জন, তারপর মিরিক হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি। পাহাড়ি রাস্তায় খাড়াইয়ের থেকেও উৎরাই বেশি শক্ত ব্যাপার। খাড়াইয়ে স্ট্যামিনা লাগে, আর উৎরাইয়ে দেহের ভারসাম্য সঠিক রাখতে বেগ পেতে হয়। প্রথমে ভেবেছিলাম, উৎরাই তো, গড়গড়িয়ে চলে যাব। কিন্তু তাড়াহুড়োতে চিরকালই পদস্খলন এর সম্ভাবনা বেশি। চিত্রে পৌছতে পৌছতে বেলা গড়িয়ে গেল। চিত্রেয় খুব সুন্দর একটি মনাস্ট্রি আছে। কিন্তু সময়াভাবে সেটা আর দেখা হল না। “আবার আসব শিগগির”, এই ভাবতে ভাবতে মিরিক পেরলো, মোমো আর থুকপা খাওয়া হল। স্যুভেনির কেনা হল। অবশেষে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌছে খরচাপাতির হিসেব করতে বসা হল। শায়িত বুদ্ধের দেশ ছেড়ে আবার জাগতিক-দেশে ফিরছি যে। 






ঈশানী চক্রবর্তী
১৯৯৫

1 comment:

  1. পরের বার থেকে বাংলায় হাতে লিখে স্ক্যান করে পাঠাবে আমাদের। :D
    টংলু আমার প্রিয় জায়গা। পরেরবার একেবারে সন্দকফু পর্যন্ত যেও।

    ReplyDelete