১
আবার ফিরবে কি না, অতশত না ভেবেই ঘর ছেড়েছে আমুদা। জন্মইস্তক ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া নামের সঙ্গে তেমন ভাব হল না এদ্দিন, তো ঘর! আমুদা যখন ষোল, গোপালের সাথে বিয়ে দিয়েছিল বাবা-মা। ইশকুল যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছিল বিয়ের বছর দুয়েক আগে, না মেয়ে ঘরের কাজকম্মে একটু হাত পাকাবে! বিয়ের পর তিন বছর কাটল কী কাটল না, গোপালের দুই ছেলের মা হয়ে গেল আমুদা। দেখতে দেখতে সে এখন আঠাশ। আশপাশে আর পাঁচজনের মতোই অজান্তে কেটে গেছে দিন-মাস-বছর। আমুদার দুই-তিন ঘর পরেই থাকে মণি। বউ-বাচ্চা নিয়ে পুরনো সংসার। কোনও এক বসন্তদিনে মণিকে হঠাৎ অন্যরকম করে ভাল লাগল কেন তার তেমন ব্যাখ্যা নেই আমুদার কাছে। মণির বউ লক্ষ্মীর চিৎকারে বত্রিশঘর বাসিন্দা কেবল জানল এরা দুজন ছোট্ট রূপার একজোড়া দুল নিয়ে ভাগলবা হয়েছে। দুলজোড়া রূপার চাইতে বেশী কাজে দিত লক্ষ্মীর। দু’দিন অন্তর বন্ধক রেখে সংসারের এটা-ওটা হাজারো দাবি-দাওয়া মেটানো। মণি গেছে গেছে, দুল গেছে এইটা মেনে নেওয়া লক্ষ্মীর পক্ষে বড় কঠিন! সত্যি বলতে লক্ষ্মীর ঘরে এখন বড়ই অর্থসংকট। গোপালের ঘরে দুই বাচ্চা নিয়ে চরম অনর্থ। এরা দু’জন দু’জনকে গালাগালি দিয়ে দারিদ্রের ঘেন্নাটুকু পুষিয়ে ন্যায় আজকাল! মাস ঘুরল কি ঘুরল না, বত্রিশ পরিবার আবার একজোট হল। বত্রিশ চারে একশ আঠাশ মাথায়ে ঠোকাঠুকি লাগার উপক্রম। কী না, ফিরে এসেছে মণি। লক্ষ্মীর ঘরে। আর ফিরেছে আমুদা। গোপালের ঘরে। অ্যাদ্দিন পর বাবাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ ক্যোঁৎ করে গিলে ন্যায় রূপা। মার চোখে আগুন। মার চোখে জল। জেতে কী হারে! এদিকে মেলা বাগবিতণ্ডায় না গিয়ে গোপাল বেধড়ক ঠ্যাঙায় আমুদাকে। আমুদাও চুপ করে মার খাবার পাত্রী নয়। অতএব মৌনমুখর অযৌন সহবাস দুই ঘর ছাপিয়ে রাস্তা, রাস্তা ছাপিয়ে চৌরাস্তা, সেখান থেকে হাইওয়ে পৌঁছায়। ঘুরে মরে। মাথা কোটে। শেষমেশ নামহীন উদ্দেশহীন মাতালের মত হাক্লান্ত পড়ে থাকে রাস্তার পাশে। বত্রিশ পরিবার ফের মাঝসমুদ্রে গা ভাসায়। লক্ষি-মণির ঘর গোপাল-আমুদার ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবলেশহীন।
আমুদার প্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তনে উত্তেজনার রেশ ফিকে হয় দ্রুত। উঠোনের জমায়েত পাতলা হতে থাকে। গোপাল, মণি, আমুদা আর লক্ষ্মী তাও নিজেদের মতো করে সমবেদনা পায় মাঝেমধ্যে। দিনমজুরির ক্লান্তি কাটিয়ে একটু পরচর্চার সময় জোটে যখন পড়শিদের।
২
নাছোড়বান্দা অ্যালার্মের শব্দে অগত্যা চোখ কচলে উঠে পড়ে অ্যাশলি। নামমাত্র ঘুম হয়েছে রাতে। সকালবেলার এই খিঁচড়ানো অতৃপ্তি সারাটা দিন তাড়া করে ফিরবে তাকে। ক্লান্ত শরীরটা যখন ঘরে আসবে রাতে, ঘুমের কাছে সঁপে দিতে চাইবে সর্বস্ব, আবারও লোরেটা আসবে দেওয়াল ফুঁড়ে! আজ-কাল-পরশু, অনন্তকাল এমনটাই হয়ে চলবে তার সাথে।
অ্যাশলি মাঝে মাঝে ভাবে, লোরেটা যেমনটি করে রোজ, ঠিক ওইটেই সে করে উঠতে পারে না কেন! নতুন নতুন বয়ফ্রেন্ড-দেদার ফুর্তি-শরীরসর্বস্ব যাপন। তাদের আকাশ-পাতাল আলাদা জীবনের দায় যেন মাঝের ওই দেওয়ালটকুর! এ বাড়িটা বদলাতে পারলে বেঁচে যেত সে। কিন্তু চাইলেই কি হয়? শস্তায় ঘর পাওয়া কী যে মুশকিল এখানে।
অ্যাশলি গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট। অতএব ডরমিটরির চাইতে একটু বেশি প্রাইভেসি তার প্রাপ্য। ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়ে যা সামান্য রোজগার হয় তাই দিয়ে টেনেটুনে চলে তার। মিঠির মত সুন্দর ফ্যাকাল্টি অ্যাপার্টমেন্ট তার কপালে নেই। মিঠি তারই ল্যাবে ভিজিটিং স্কলার। অ্যাশলির সামান্য সিনিয়র। তবে ওর ব্যাপারটা স্পেশাল! সুযোগ পেলে কখনও মিঠির দেশে যাবে সে। অ্যাশলি বেজায় বাঘভক্ত। তার পোষা বেড়ালের নাম টাইগার। মিঠি হাসতে হাসতে বলছিল একদিন, তাদের দেশে বাঘে-মানুষে এক ঘাটে জল খায়!
পৃথিবীর সবচাইতে বেশি বেঙ্গল টাইগার কেমন করে ওই জনারণ্যে বাস করে ভেবেই কূলকিনারা পায় না অ্যাশলি। কল্পনায় দ্যাখে সে, দেওয়ালের একদিকে তার সংসার অন্যদিকে বেঙ্গল টাইগারদের পরিবার। সে কান্ট্রি মিউজিক চালালে ওরা চমকে ওঠে। বাঘ-মা ছানাকে বকুনি দিলে অ্যাশলি বিষম খায়। হঠাৎ কখনও মুখোমুখি হলে দুপক্ষই বেজায় ঘাবড়ায়। তার বিশ্বাস লোরেটার চাইতে বাঘের সাথে বাস করা অনেক শান্তির হতো। সে ভাগ্য কি কোনওদিন হবে আর? দীর্ঘশ্বাস পড়ে অ্যাশলির।
৩
মণির চোখ আটকেছে এই বিশেষ গর্তটায়। এত্ত বড় ধানজমিতে মেঠো ইঁদুরের গর্ত তো কম নয়। কিন্তু এইটেই যখন চুম্বকের মতো টেনেছে মণিকে, এ গর্ত নিশ্চয়ই আলাদা! মিঠি জানে থামতে হবে কিছুক্ষণ। উত্তেজনায় চকচক করছে মণির মুখচোখ। হাতে ধরা লোহার শাবলে শক্ত হচ্ছে মুঠো। এখন মণি ভুলে গেছে তার ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। ভুলে গেছে ঘর বলতে তার আছে মাটির বাড়িতে খড়ের চাল। শিকারী মণি মিঠির চোখে ম্যাজিশিয়ান! এই মানুষটার সাথে আপাত নিরীহ মুখচোরা মণির কোন মিল নেই।
গর্তের মুখটুকু দেখলে ইঁদুর পরিবারের কারিগরি দক্ষতাকে হেয় করা হয়। জমির সাথে সমান্তরালে সুড়ঙ্গ চলেছে অদৃশ্য। তার দৈর্ঘ্য নেহাত কম নয়। সুড়ঙ্গের এক মুখে লোহার ডাণ্ডা কৌশলে এগোয় তো অন্য মুখের দিকে সরে যায় বাসিন্দারা। তারা এও জানে ওখানে ঘাপটি মেরে বসে আছে মিঠি। সে কিম্বা মণি একটু অন্যমনস্ক হলেই তিন লাফে স্রেফ হাওয়া হয়ে যাবে তারা।
কর্ষণক্লান্ত মণি, জিরনোর ফাঁকে মিঠির কাছে ব্যাখ্যা করে বন্দীদের বংশলতিকা। মা-বাবা-বড় ছেলে-ছোট মেয়ে সব মিলিয়ে বিশাল পরিবার! ইঁদুরদের দিকে নিঃস্পৃহ মার্জার দৃষ্টিতে চায় মিঠি। দেখে বোঝার উপায় নেই কী আশ্চর্য ক্ষমতা এদের ফসল নষ্ট করার আর বংশ বৃদ্ধির! জন্মের পঁয়তাল্লিশ দিনের মাথায় ঘর বেঁধেছিল এই মা- ইঁদুর। তারপর থেকে অক্লান্ত বংশরক্ষা। এখন সাকুল্যে ১২ জনের পরিবার!
কাঠকুটোর আগুনে নধরকান্তি বন্দীরা উৎসর্গীকৃত হয়। মাংস গন্ধে ভারী ধোঁয়া এড়াতে সরে বসে মিঠি। মণির আজ বেজায় আনন্দ যে মাদাম তার সাথে ইঁদুর রোস্ট খাবেন। মাঠেঘাটে সদ্য ধরা শিকারের মাংস ভাগ করে খাওয়ার আনন্দই আলাদা। মণি আর মাদাম খেয়ে বাকি যা থাকবে সেটা ঢুকবে লক্ষ্মীর হেশেলে।
অন্যমনস্ক মিঠি দেখতে পায় হাতে শিকার ঝুলিয়ে ঘরে ফিরছে মণি। ধানজমির কাজ সেরে আগেই ফিরেছে লক্ষ্মী। রূপার সাথে দাওয়ায় বসে পথ চেয়ে আছে মণির। বাবার হাতে অত ইঁদুর দেখে রূপার আহ্লাদ আর ধরে না! ঘরভর্তি তৃপ্তির আমেজ। অনেকদিন পর আজ পেটপুরে মাংস-ভাত খাবে সবাই।
ডালিয়া ঘোষ দস্তিদার
১৯৯৬
ডালিয়া দির লেখার প্লটটা দারুউউণ! খুব ভালো লেগেছে ডালিয়া দি!
ReplyDeleteThank you Arundhati :-)
Deleteএই লেখাটা বহুদিন আগে প্রথম পড়বার সৌভাগ্য হয়েছিল। :) সম্পাদক হিসেবে তাই সঠিক সময়ে মনে করিয়ে দিতে পেরেছিলাম যে এই লেখাটা আমার চাই। :D
ReplyDeleteভেতর ও বাহির... এই দুই ঘরের বহুরকম কুঠুরির সন্ধান আছে এ-লেখায়। ভাল লেগেছিল তাই।
দারুন
ReplyDelete