নিবেদিত-প্রাণ নিবেদিতা


আয়ারল্যান্ড নিবাসী মিস মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল স্বামীজির সান্নিধ্যে এসে ভারতকে মনে প্রাণে আপন করে হয়ে উঠেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা আর গুরুদত্ত নামকেও প্রকৃত অর্থে সফল করেছিলেন। স্বামীজির সাহচর্য তাঁকে নিজের জন্মগত সংস্কার ত্যাগ করে ভারতীয় সংস্কারে রাঙিয়ে তুলেছিল মূলত শাশ্বত সত্য বা অধ্যাত্ম চেতনার প্রকাশ নিবেদিতাকে করে তুলেছিল স্বামীজির মানসকন্যা।

ভারতের আধ্যাত্মিকতা তাঁকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে ছিল। তাই ১৮৯৯ সালে রিজলি ম্যানরে থাকাকালীন লিখেছিলেন "কালী দ্য মাদার"। একবার ১৬নং বোস পাড়া লেনের বস্তি থেকে উচ্চকণ্ঠে কান্নার শব্দে বিচলিত হয়ে গিয়ে দেখেন পরিবারের শিশুকন্যাটি মারা গেছে। মায়ের করুণ প্রশ্নের উত্তরে নিবেদিতা বললেন, চুপ, তোমার মেয়ে এখন মা কালীর কোলে এভাবেই তিনি সেদিন সেই শোকার্ত পরিবারে সান্ত্বনা দান করেছিলেন। অর্থাৎ তিনিও ঠাকুর ও স্বামীজির মতো অনুধাবন করেছিলেন যে প্রকৃত ধর্ম একই-সে কালীই হোক আর যীশু তিনি যখন মার্কিন দেশে স্কুল চালানোর জন্য অর্থসংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন, তখন নানান প্রশ্নের সামনে পড়েন, আপনি কি খ্রিস্ট ধর্ম ত্যাগ করেছেন? দৃঢ়কণ্ঠে উত্তরঃ রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ৩জন সদস্যের ভেতর (ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার এবং মিস মার্গারেট) আমি একজন


নিবেদিতা ও স্বাধী্নতা সংগ্রামঃ

এই দেশের স্বাধী্নতা সংগ্রামে তাঁর অবদান যেমন ছিল অপরিসীম, তেমনি তাঁকে অনেক ঝামেলার সম্মুখীনও হতে হয়েছিল। কর্নেল আই এ সোহরাবজি (ইংরেজ সরকারের বেতনভোগী গোয়েন্দা) দীর্ঘদিন ধরে নিবেদিতাকে অনুসরণ (ফলো) করতেন গোখলের মারফত তিনি যখন নিবেদিতার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন, তখন ১৯০৪-এর ইয়েস্টারডে-তে চিঠি মারফত গোখলেকে সব জানিয়ে সে চেষ্টা বরবাদ করে দেন। ১৯১০ সালে ভাইসরয় পত্নী বেলুড়মঠে গেলে নিবেদিতার অনুপস্থিতিতে কর্নেল আই এ সোহরাবজি তাঁকে বেশ কিছু সরাসরি প্রশ্ন করেন, যেমন মঠের সাথে তাঁর সম্পর্ক, মঠ কি রাজনৈতিক ব্যাপারে আগ্রহী ইত্যাদি, যা আদতে ছিল চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য

নিবেদিতার বিরুদ্ধে পুলিশের নানা অভিযোগ ছিল। কারণ তিনি ছিলেন বিপ্লবী পত্রিকা যুগান্তর এর পরম পৃষ্ঠপোষক। ১৯১০-এর ২৮ এপ্রিল র‍্যাটক্লিফ দম্পাতিকে জানান যে, তিনি সি আই ডি-র তালিকাভুক্ত। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি ডাকাতির জন্যে দায়ী ও তিনি নাকি সর্বাত্মক প্রেরণাদাত্রীআসলে তাঁর মতবাদ ছিল নেশন মেকিংতিনি নিজনাম ও ছদ্মনামে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতেন ইংরেজদের "স্টেটসম্যান", "মডার্ন রিভিউ" সংবাদপত্রে।স্বাধীনতা সংগ্রামের সূত্র ধরে শ্রী অরবিন্দের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। শ্রী অরবিন্দ তাঁর সঙ্গে নিবেদিতার প্রথম দেখা হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন, আমি মনে করতে পারছি না উনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন কিনা বরোদাতে। হয়তো উনি রাজ-অতিথি রূপে এসেছিলেন। সে সময় আমি তাঁর "কালী দ্য মাদার" পড়ে মোহিত। তিনি বলেছিলেন তিনি শক্তি উপাসক হয়তো উনি এর দ্বারা বলতে চেয়েছিলেন যে তিনিও আমাদের মতো গুপ্ত বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত

এর পরে কলকাতাতে এসে শ্রী অরবিন্দ একটি কমিটির অধীনে স্বাধীনতা সংগ্রাম করা শ্রেয় বোধ করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন- ব্যারিস্টার পি মিত্র হবেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের নেতা। ৫ জনকে নিয়ে একটি পরিষদ গঠিত হল। নিবেদিতা ছিলেন তাঁদের ভেতর অন্যতম শ্রী অরবিন্দ যে নিবেদিতার ওপর বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের জন্যে নির্ভর ও ভরসা করতেন এর থেকে তা প্রমাণিত হয়।


নিবেদিতা ও ডঃ জগদীশ চন্দ্র বসুঃ



১৮৯৮ এর শেষের দিকে নিবেদিতার সঙ্গে ডঃ জগদীশ চন্দ্র বসুর দেখা হয়। ডঃ জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবনের সব থেকে সঙ্কটকাল ছিল এই সময়। পরাধীন দেশে জন্মানো যে কত বড় অভিশাপ তা এই সময়ই তিনি অনুভব করেন। লর্ড রালি-র সহযোগিতায় লন্ডনের লিভারপুলে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানের প্রথম বক্তৃতায় বিখ্যাত লর্ড কেলভিন-এর মন জয় করে নেন। তিনি ভারতে বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠার জন্যে ভারত সচিবকে চিঠি লিখে অনুরোধ জানান। কিন্তু ভারতে ফিরে আসার পর পরিস্থিতি পুরো পালটে যায়-চরম অসহযোগিতার সামনে পড়েন তিনি। গবেষণার প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য তো পাননিই, এমনকি তাঁর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও অস্বীকার করা হয়। ক্রমাগত বাধার সম্মুখীন হতে হতে তিনি হতাশ হয়ে পড়েননিবেদিতা ডঃ জগদীশ চন্দ্র বসুর প্রতিভার এহেন অবহেলা মেনে নিতে পারেননি। তিনি মনে করতেন ডঃ বসু তাঁর গবেষণায় সাফল্য লাভ করলে পরাধীন ভারত বিশ্বের দরবারে বিশেষ মর্যাদা লাভ করবে। ১৯০১ সাল থেকে নিবেদিতা ডঃ বসুকে গবেষণার কাজে সাহায্য করতে থাকেন। এই সময়ই ডঃ বসুর ৩টি বই প্রকাশিত হয়-রেস্পন্স ইন দ্য লিভিং অ্যান্ড নন-লিভিং, প্ল্যান্ট রেসপন্স অ্যান্ড কম্পারেটিভ ইলেক্ট্রো-ফিজিওলজিনিবেদিতার অসাধারণ ভাষা-নৈপুণ্য এই বইগুলির প্রকাশে অপরিসীম সাহায্য করেছিল। নিবেদিতার একান্ত ইচ্ছা ছিল ভারতের অর্থে এই দেশেই একটি বিজ্ঞান-মন্দির স্থাপন করা হবে, যেখানে এই দেশের ছেলেমেয়েরা গবেষণার অবাধ সুযোগ পাবে। পরবর্তী কালে ডঃ বসুর নির্মিত "বোস ইন্সটিটিউট"-এর দ্বারে যে দীপ-হস্তে নারী মূর্তি খোদিত দেখা যায় তা বোধ হয় নিবেদিতার প্রতিই ডঃ বসুর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।


 মৈত্রেয়ী চ্যাটার্জী [২০০৫]

No comments:

Post a Comment