"এতো ভারী কেন ব্যাগটা? লোহালক্কড় ঢুকিয়েছিস নাকি?"- পড়ার টেবিল থেকে নামিয়ে চেয়ারে রাখতে গিয়ে মা
বলল। "আছে সব দরকারি জিনিস।" গম্ভীর মুখে আমার উত্তর। উত্তরটা মায়ের পছন্দ
না হলেও আমার পক্ষে ঐ ৯টা ৩৫-এর সময় মাকে সত্যিই 'দরকারি' জিনিষের লিস্টিটা বলা সম্ভব ছিল না। পৌনে দশটায় স্কুল-বাস
আসে। কাল লেট করেছি। আজ করলে হুলো কাকু আমায় না তুলেই বাস ছেড়ে দেবে।
প্রেয়ারের শেষে সবাই ক্লাসরুমে গিয়ে স্তবের পর যখন বইখাতা
বার করছে, তখন একদল মেয়ে ব্যাগপত্তর ঘাড়ে করে ক্লাস
থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এরা হল তারা, যাদের ব্যাগে 'দরকারি' জিনিসপত্র আছে। এদের শাড়ির আঁচলে কমলা, হলুদ, সবুজ ইত্যাদি ভিবজিওর ছোপ ছোপ। এদের চোখে রোমান যোদ্ধার
তেজ। এদের দু'একজনের পিঠে ব্যাগের সাথে কাঁধে ঝোলা। ঝোলা
থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে একটা বোর্ড, দুটো আর্ট পেপারের রোল। আর এই দলের অগ্রভাগে যে
বেঁটে মতো চশমা পরা শ্যামলা মেয়েটা, তার মুখে অকৃত্রিম একটা টেনশন! এই বাহিনী ক্লাসরুম ছেড়ে বেরনোর সময় বাকি
মেয়েরা কেমন একটা চকচকে চোখে স্মিত হাসি মুখে নিয়ে এদের দিকে তাকায় - ভাবটা এমন যেন এই বাহিনীই তো দেশের নাম, থুড়ি ক্লাসের নাম উজ্জ্বল করবে।
অগাস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। ফার্স্ট পিরিয়ডের পর থেকেই
সারা স্কুলের সমস্ত বারান্দা দিয়ে খুব সযত্নে স্ট্রেচারে রুগী নিয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে
হাঁটাচলা করতে দেখা যায় মেয়েদের। তারপর থেকে মোটামুটি সারাদিনই ক্লাসের চাইতে ক্লাসের
বাইরে মেয়েদের চলাফেরা বেশি লক্ষ্য করা যায়। কখনও দেখা যায় গোটা একটা ক্লাসরুমই
খালি। সেসব মেয়েদের নয় খুঁজে পাওয়া যায় ডাম্বেল হাতে উঠোনে, কিম্বা বাঁশি হাতে চার নম্বর
ঘরের বারান্দায়। সব মিলিয়ে গোটা বছরের তুলনায় ভারি অন্যরকম চালচলন।
এই ব্লগজিন আমাদের স্কুলের মেয়েদেরই। তাই
পাঠকও অধিকাংশই স্কুলের মেয়েরা এবং দিদিরা। তাও যারা এই দুই ক্যাটেগরির বাইরে, তাদের খানিক কনফিউজ করব বলে লেখাটা গোড়ায় এমন
হেঁয়ালি করে শুরু করলাম।
অগাস্ট হল আমাদের কাছে এক মহোৎসবের মাস। দশে মিলি করি কাজের
আদর্শ উদাহরণ। তখন নিবেদিতা স্কুলের প্রতিটা ক্লাসরুম-ঘর-দালান-উঠোন....তিন আর চার নম্বরের বন্ধ দরজার ভেতর থেকে
ড্রামের আওয়াজ - উজ্জ্বলাদির বকুনির আওয়াজ। উঠোনে সমানে চলছে "এক দো-এক
দো-এক দো-এক"। অঞ্জুশ্রীদির প্যারেড বাহিনী যতবার ডান পায়ের
জায়গায় বাঁ পা ফেলছে, ততবার 'রিপ্লে'। নীচের এসব কান্ড দেখতে দেখতে দোতলার বারান্দায় আরেকজন দিদি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে
প্যারেডের মেয়েদের খানিক বকুনি দিয়ে দিলেন "দিদির কথা শুনতে পাচ্ছ না? মন কোথায় থাকে?" আবার সেই দিদিকেই হয়তো পিছন থেকে সভয়ে ডাকছে ক্লাস ফাইভের
কোনও এক মেয়ে। তার হয়তো লেখা বোলানোর ব্রাউন স্কেচপেন শেষ হয়ে গেছে, আর সে ক্লাসের থেকে আরও চারটে পেন জোগাড় করে
পাতায় দাগ কেটে দেখাতে নিয়ে এসছে ক্লাসটিচারের কাছে। এসবের মধ্যেই ফোর সির সিঁড়ি
দিয়ে উঠলে শোনা যাবে দমাদম টেস্টপেপার পিটিয়ে গানের লয়কে ছয়গুণ বাড়িয়ে গলা ফাটিয়ে প্র্যাকটিস
চলছে টেনের ঘরে। এতো কোলাহলে শান্তি বলতে সুধীরা ভবনের একতলা অথবা তিনতলার সিঁড়ির
পাশের ঘর। এসব জায়গায় পাওয়া যাবে পাঠের মেয়েদের আর সংশ্লিষ্ট দিদিদের।
এ তো গেল স্বাধীনতা দিবসের বিচিত্র
প্রস্তুতির ধারাবিবরণ। কিন্তু এই সমস্তকে ছাপিয়ে যা নিয়ে প্রতিটা ক্লাসের প্রতিটা
মেয়ের উত্তেজনা চুড়ান্ত, সেই গুরুত্বপূর্ণ টপিক 'চার্টে'র কথা এবার বলব।
চার্টের কাজের মেয়েরা সবার মধ্যে ব্যস্ততম। আর তার মধ্যে আমরা, অর্থাৎ সেই যে বাহিনী ভিবজিওর আঁচল নিয়ে সকাল সকাল ক্লাসত্যাগী হয়েছিল, অর্থাৎ ক্লাস টেনের চার্টের মেয়েরা... হাবভাবটা এমন যেন তারা বোধহয় বড়দির চেয়েও ব্যস্ত। এদের চোখে সারাদিন কেমন একটা ঘোর। এরা সারাদিন মনে মনে "প্রাইজ চাই-শেষ বছর, প্রাইজ চাই-শেষ বছর" বলে জপ করে। এদের পিঠে ব্যাগ থাকে। তাতে থাকে রং, তুলি, শিশি, টিউব, পেন্সিল, কাগজ, ছুরি, কাঁচি, ব্লেড। আর থাকে সেই সোমবারের রুটিনের বইখাতা, যেগুলো বুধবারেও ব্যাগ থেকে অদলবদল হয় না। এরা টিফিনে টিফিন খায় না। কাজ করে। এরা ক্লাসের পর ক্লাস করে না। কাজ করে। এরা ইন্টারক্লাস কম্পিটিশনের কবিতা মুখস্থ দেয় না। তখনও কাজই করে। না,না। আমি কিন্তু একদম মজা করছি না। এরা একদম ফাঁকি দেয় না কাজে। তাতে থাক না দুটো উপপাদ্য, মহাবিদ্রোহের পরোক্ষ কারণের উপসংহারটা, গেলে যাক জগদ্দলের চরিত্রের ব্যাখ্যা। কিন্তু জীবনের শ্রেষ্ঠ ক্রিয়েটিভিটিটা ঐ কদিনের মধ্যে চার্টে ফুটিয়ে তুলতে না পারলে জীবন এক্কেরে বৃথা। আর ঐ যে বাহিনীর পুরোভাগে সেনাপতির কথা বলেছিলাম, সেই টেনশনমুখী মেয়েটির অবস্থা সবচেয়ে সঙ্গিন। সে বন্ধুদের ক্রিয়েটিভিটি প্রথমে নিজে বোঝে, তারপর তাকে যেতে হয় বড়দির কাছে। বড়দিকে সেসব বোঝাতে সফল হলে আবার তার সাথে বড়দির ক্রিয়েটিভ আইডিয়াগুলো শুনে সবটা মাথায় নিয়ে এসে বোঝাতে হয় বন্ধুদের। শুনতে সহজ লাগলেও আসলে বড়দি এবং বন্ধুপক্ষ - উভয়ের ক্রিয়েটিভ ডুয়েলের মাঝে রেফারি হয়ে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। রেফারি হল সেই প্রাণী যাকে চিরকাল মুখ-ঝামটাই খেতে হয়। ফুটবল হোক বা চার্টের ময়দানে। সেই অভাগা রেফারি আমি, ঘটনাচক্রে টেন বি-র ইউনিয়ন মেম্বার। তাই কপালে দুর্গতি আরও বিচিত্র। এই যে স্কুলে এসেও ক্লাসে অনুপস্থিত একদল মেয়ে গোটা সপ্তাংশ জুড়ে ভিঞ্চি ভিঞ্চি খেলা করবে, তারা পনেরোই অগাস্টের পর সেই আমাকেই পাকড়াও করবে ক্লাসে কী কী হল জানতে। আছে আরও কিছু উটকো বিপদ। সেভেন্থ পিরিয়ডে দেখা যাবে তেরো নম্বরে জনঘনত্ব বাড়ছে। ক্লাসের চার্টে বা অন্য কোনও কাজে না থাকা মেয়েরা এসে জড়ো হচ্ছে। কাজে মন থাকলে আশপাশ লক্ষ্য করাও কঠিন হয়ে যায়। আসলে দেখা যাবে ক্লাসে এখন বোধহয় কবিতা ধরার সময়। তাই পলায়নে উদ্যত মেয়েরা আশ্রয় নিয়েছে এইখানে। কিন্তু শেষমেশ শুভ্রাদির বকুনিটা তারা খাবে না। খাবে ইউনিয়ন মেম্বার। বকুনি-হাসাহাসি-ছুটোছুটি-ভয়-চার্ট বাতিল-আবার কাজ-টিফিন না খাওয়া-তাড়াহুড়ো এই সমস্তর মিশেলে এই একটা সপ্তাহ কেমন একটা উৎসবে কাটত। স্কুলের অন্যান্য সময়ের তুলনায় বকাঝকা এ-ক’দিন বেশি চলত, পড়াশোনা হতো কম আর নিয়মের কিছু ফাঁকফোকর দিয়ে দুষ্টুমি বেড়ে যেত দ্বিগুণ। আমার লেখাটার মতোই তাড়াহুড়ো আর অগোছালো ভাবে এগিয়ে চলত ক্লাস টেনের চার্ট। এ গল্প শুধু আমাদের গল্প নয়। এ গল্প প্রতি বছরের ক্লাস টেনের গল্প। কিভাবে যেন এই ক্লাসছুট মেয়েগুলো তৈরি করে ফেলত একটা সম্পূর্ণ কাজ। তাদের স্কুলজীবনের শেষ চার্ট। সম্ভবত এই দশ বছরে সবচেয়ে যত্ন করে তৈরি করা চার্ট।
চার্টের কাজের মেয়েরা সবার মধ্যে ব্যস্ততম। আর তার মধ্যে আমরা, অর্থাৎ সেই যে বাহিনী ভিবজিওর আঁচল নিয়ে সকাল সকাল ক্লাসত্যাগী হয়েছিল, অর্থাৎ ক্লাস টেনের চার্টের মেয়েরা... হাবভাবটা এমন যেন তারা বোধহয় বড়দির চেয়েও ব্যস্ত। এদের চোখে সারাদিন কেমন একটা ঘোর। এরা সারাদিন মনে মনে "প্রাইজ চাই-শেষ বছর, প্রাইজ চাই-শেষ বছর" বলে জপ করে। এদের পিঠে ব্যাগ থাকে। তাতে থাকে রং, তুলি, শিশি, টিউব, পেন্সিল, কাগজ, ছুরি, কাঁচি, ব্লেড। আর থাকে সেই সোমবারের রুটিনের বইখাতা, যেগুলো বুধবারেও ব্যাগ থেকে অদলবদল হয় না। এরা টিফিনে টিফিন খায় না। কাজ করে। এরা ক্লাসের পর ক্লাস করে না। কাজ করে। এরা ইন্টারক্লাস কম্পিটিশনের কবিতা মুখস্থ দেয় না। তখনও কাজই করে। না,না। আমি কিন্তু একদম মজা করছি না। এরা একদম ফাঁকি দেয় না কাজে। তাতে থাক না দুটো উপপাদ্য, মহাবিদ্রোহের পরোক্ষ কারণের উপসংহারটা, গেলে যাক জগদ্দলের চরিত্রের ব্যাখ্যা। কিন্তু জীবনের শ্রেষ্ঠ ক্রিয়েটিভিটিটা ঐ কদিনের মধ্যে চার্টে ফুটিয়ে তুলতে না পারলে জীবন এক্কেরে বৃথা। আর ঐ যে বাহিনীর পুরোভাগে সেনাপতির কথা বলেছিলাম, সেই টেনশনমুখী মেয়েটির অবস্থা সবচেয়ে সঙ্গিন। সে বন্ধুদের ক্রিয়েটিভিটি প্রথমে নিজে বোঝে, তারপর তাকে যেতে হয় বড়দির কাছে। বড়দিকে সেসব বোঝাতে সফল হলে আবার তার সাথে বড়দির ক্রিয়েটিভ আইডিয়াগুলো শুনে সবটা মাথায় নিয়ে এসে বোঝাতে হয় বন্ধুদের। শুনতে সহজ লাগলেও আসলে বড়দি এবং বন্ধুপক্ষ - উভয়ের ক্রিয়েটিভ ডুয়েলের মাঝে রেফারি হয়ে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। রেফারি হল সেই প্রাণী যাকে চিরকাল মুখ-ঝামটাই খেতে হয়। ফুটবল হোক বা চার্টের ময়দানে। সেই অভাগা রেফারি আমি, ঘটনাচক্রে টেন বি-র ইউনিয়ন মেম্বার। তাই কপালে দুর্গতি আরও বিচিত্র। এই যে স্কুলে এসেও ক্লাসে অনুপস্থিত একদল মেয়ে গোটা সপ্তাংশ জুড়ে ভিঞ্চি ভিঞ্চি খেলা করবে, তারা পনেরোই অগাস্টের পর সেই আমাকেই পাকড়াও করবে ক্লাসে কী কী হল জানতে। আছে আরও কিছু উটকো বিপদ। সেভেন্থ পিরিয়ডে দেখা যাবে তেরো নম্বরে জনঘনত্ব বাড়ছে। ক্লাসের চার্টে বা অন্য কোনও কাজে না থাকা মেয়েরা এসে জড়ো হচ্ছে। কাজে মন থাকলে আশপাশ লক্ষ্য করাও কঠিন হয়ে যায়। আসলে দেখা যাবে ক্লাসে এখন বোধহয় কবিতা ধরার সময়। তাই পলায়নে উদ্যত মেয়েরা আশ্রয় নিয়েছে এইখানে। কিন্তু শেষমেশ শুভ্রাদির বকুনিটা তারা খাবে না। খাবে ইউনিয়ন মেম্বার। বকুনি-হাসাহাসি-ছুটোছুটি-ভয়-চার্ট বাতিল-আবার কাজ-টিফিন না খাওয়া-তাড়াহুড়ো এই সমস্তর মিশেলে এই একটা সপ্তাহ কেমন একটা উৎসবে কাটত। স্কুলের অন্যান্য সময়ের তুলনায় বকাঝকা এ-ক’দিন বেশি চলত, পড়াশোনা হতো কম আর নিয়মের কিছু ফাঁকফোকর দিয়ে দুষ্টুমি বেড়ে যেত দ্বিগুণ। আমার লেখাটার মতোই তাড়াহুড়ো আর অগোছালো ভাবে এগিয়ে চলত ক্লাস টেনের চার্ট। এ গল্প শুধু আমাদের গল্প নয়। এ গল্প প্রতি বছরের ক্লাস টেনের গল্প। কিভাবে যেন এই ক্লাসছুট মেয়েগুলো তৈরি করে ফেলত একটা সম্পূর্ণ কাজ। তাদের স্কুলজীবনের শেষ চার্ট। সম্ভবত এই দশ বছরে সবচেয়ে যত্ন করে তৈরি করা চার্ট।
দীক্ষা দত্ত [২০১৪]
No comments:
Post a Comment