ইশকুলের আনাচকানাচ


ফেসবুকে, আমাদের ইশকুল নামে যে অ্যালামনি বা প্রাক্তনীদের গ্রুপ, সেখানে স্কুলের হাজারখানেক বিষয় নিয়ে প্রায়শই বিবিধ নস্টালজিক আড্ডা চলতেই থাকে। এই লেখায় স্কুলবাড়ির বিভিন্ন জায়গা নিয়ে যা যা রোমন্থন হয়েছে, সেসব কিছু টুকরো কথা রইল। 

ক্যান্টিন

চান্দ্রেয়ী লাহিড়ীঃ ক্যান্টিন নিয়ে কিছু আড্ডা হয়ে যাক। আলু কাবলিতে নুন আর তেঁতুল ছাড়া কিছু থাকত না, তাও ওটাই আমার খাওয়া সেরা আলুকাবলি। একটা পাতলা পরোটা হতো আর আলুর দম। আলুর দমটা শেষ হয়ে যেত খুব তাড়াতাড়ি। তখন আলুকাবলি দিয়েই পরোটা খাওয়া হতো। ছোট ঘরটায় পরোটা ভাজা হতো আর আমরা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দাঁড়িয়ে পড়তাম। পরোটা এলেই যাতে হস্তগত হয়। বাড়ি থেকে টিফিন না আনার একটা না একটা বাহানা বানাতাম ওই ক্যান্টিনে খাব বলে। আর নিজে কেনার আনন্দটা বিরাট ছিল! মনে হতো কেউকেটা হলাম।


অপরাজিতা মিত্রঃ আলুকাবলি! দুটো লুচি আর দুটো আলুর দম। কোনও কোনও দিন শুধু আচারও থাকত। আচারটা খুব ভাল হতো, তেঁতুলের! এখনও ভাবলেই আমার জিভে জল!

চিরশ্রী মজুমদারঃ আর শিল্প-প্রদর্শনীতে ক্যান্টিনের স্পেশাল মেনু থাকত! নিজে হাতে পয়সা দিয়ে কিছু কিনে খাওয়ার প্রথম হাতেখড়ি ওই ক্যান্টিনেই। দারুণ ক্ষুধা উদ্রেককারী গন্ধ বের হতো সেই ফোর্থ পিরিয়ড থেকেই। আহা, এখনও পাচ্ছি!

সঙ্গীতা অগ্নিহোত্রী ব্যানার্জীঃ আমরা হস্টেলের মেয়েরা তো ক্যান্টিন থেকে কিনে খেতামই। তবে খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত।

শর্মিলা রায়ঃ গোলা রুটি প্রথম ওখানেই খেয়েছিলাম আর বাড়ি এসে বায়না করতাম বানিয়ে দেওয়ার জন্য। মাকে ঠিক করে বোঝাতেই পারিনি কখনও!

প্রমিতা মৈত্রঃ শালপাতায় মুড়ে আলুকাবলি দিত। আর তার ঝোল হাত গড়িয়ে জামায় মেখে একাকার হতো! তাও সেটা নেওয়ার জন্য ফোর্থ পিরিয়ড থেকে মনে হতো আজ যেন দিদি একটু বেশি পড়াচ্ছেন! ওদিকে সবাই লুটে নিল বোধ হয় আলুকাবলি।

রাই বোসঃ কিন্তু ক্যান্টিন তো কবেই উঠে গেছে! ওখানে তো লিফট বসেছে। বয়স্ক দিদিদের জন্য। আচার এখন শুধুই পাওয়া যায় শিল্পবিভাগের মেলায়।

সকলেঃ সে কি!! ক্যান্টিন আর নেই!!!

রাজশ্রী দত্তঃ আহাহা! সেই আলুকাবলির জন্য পয়সা জমাতাম একটু একটু করে। প্রথমে ২৫ পয়সা ছিল। তারপর ৫০ পয়সা হল। তবে অনেকটাই দিত। তবে যতই তেঁতুলজলে ভাসুক না কেন, ওই জলে সাঁতরানো আলুর স্বাদ আজও ভুলিনি।

আহেলি গুহ রায়ঃ ক্যান্টিন আজ শুধুই ইতিহাস!


ফোর-সি বিল্ডিং-এর লাইব্রেরি

স্বাতী রায়ঃ তোমরা কেউ ফোর সি বিল্ডিঙের ওপরতলায় যে লাইব্রেরি ছিল সেটার কথা বলবে? যেখানে অনেক অনেক মুকুল, শিশুসাথীর বাঁধানো কালেকশন রাখা ছিল? আর যার জানালা দিয়ে সেই দূউউউরে হাওড়া ব্রিজ ছাড়িয়ে আরও দূরে চলে যাওয়া যেত...

দোয়েলপাখি দাশগুপ্তঃ ওই ঘরটার নাম দিয়েছিনু চোরকুঠুরি

স্বাতীঃ আরও বল! আরও বল! আমি মনে মনে এখনও সেইসব বইয়ের গন্ধ পাচ্ছি! আহা কী কালেকশন ছিল!

দোয়েলপাখিঃ আমাদের সময় কালেকশন আর ততো ভাল ছিল না। তবে বই ভালবাসি বলে ঘরটার মাহাত্ম্যই আলাদা ছিল। লাইব্রেরি ক্লাসে বই আনা-নেওয়া করতে যতবারই ঘরটায় ঢুকতাম, সেইসব বইয়ের গন্ধ... মনে হতো এরকম একটা ঘরে বেশ কয়েক পিরিয়ডের জন্য আমাদের ছেড়ে দেয় না কেন! শুধু বই আর আমি... একলা শুয়ে-বসে-উপুড় হয়ে গড়িয়ে বই পড়ব। এ বই- সে বই... রিনাদিরা যে মস্ত লাইব্রেরি ঘরে বসতেন সে ঘরে এই চোরকুঠুরির মতো নিষিদ্ধ ইচ্ছার হাতছানি ছিল না।

স্বাতীঃ আমাদের সময়ে আমজনতার লাইব্রেরি ছিল মেন বিল্ডিং-এ। সেখানে বসতেন রিনাদি (আর বন্ধুর টানে টিচার্স রুম ছেড়ে ঝর্নাদি)। সে ছিল সাজানো ঘর, পরিপাটি গুছনো। কিন্তু ফোর সি বিল্ডিং-এর ঘর ছিল তালা দেওয়া স্বপ্নের জাদুঘর। মাঝে মাঝে কোনও সিনিয়র টিচার বা ঝর্নাদি ইচ্ছে হলে পাঁচশ তালা খুলে কাউকে কাউকে সেঘরে ঢুকতে দিতেন। ওই বইগুলোর অধিকাংশই হয়তো আর কখনও পাওয়া যাবে না।

দোয়েলপাখিঃ বইগুলো যে পাওয়া যাবে না একথা অনেকটাই সত্যি। এদেশে সংরক্ষণ বা পুনর্মুদ্রণের চর্চা তো প্রায় নেই। ছোটবেলার অমূল্য সমস্ত বই এভাবেই একদিন চুপি চুপি উধাও হয়ে যায়। মাথা খুঁড়ে মরলেও সে বই আর কোনওদিন পাওয়া যায় না, যদি না কারওর ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকে।

স্বাতীঃ ঠিক কথা। আর আজকের অ্যাপার্টমেন্টের যুগে পার্সোনাল কালেকশন মেনটেন করাও খুব কঠিন। বাংলা বইয়ের, বিশেষত কপিরাইটহীন, একশ বছরের পুরনো বইয়ের একটা অনলাইন লাইব্ররি করা যায় না?

দোয়েলপাখিঃ জানি না, অনেক উদ্যোগ যদিও হচ্ছে ক্রমশ। বহু লেখকের রচনাবলীও এসে গিয়েছে অনলাইন। তবে সব তো ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্ভব না। সরকারি উদ্যোগও প্রয়োজন।


ঠাকুরদালান আর উঠোনের একটুকরো খেলার জায়গা


দ্যুতি মুস্তাফিঃ ঠাকুরদালান আর উঠোনের ওই এক টুকরো চৌহদ্দিতে আমরা কতকিছু খেলতাম মনে পড়ে? নাইনের দিদিরা যখন টিফিনের শেষে ঝাঁট দিত, তখনও খেলা শেষ হতো না। মাধ্যমিকের সময় খো খো। কিন্তু তার আগেই জেলেমাছ, কুমিরডাঙা এইসব খেলেছি কত।

অর্পিতা ঘোষঃ খো খো আমার দারুণ প্রিয় খেলা। আর খেলতাম লক অ্যান্ড কি।

সায়নী সেনগুপ্তঃ আমরা কাবাডি আর চিকলেট খেলতাম।

সবাইঃ চিকলেট আবার কী খেলা!

সায়নীঃ সে অদ্ভুত পাগলামির খেলা! যে চোর হবে সে একজনের নাম বলে তার পিছনে ছুটবে। ধরে ফেললে সে চোর। আর না হলে যে পালাচ্ছে সে অন্য কারওর নাম বললে, চোরকে এবার তার পেছনে ছুটতে হবে। এক কথায় চোরের দুরবস্থার একশেষ!

দ্যুতিঃ ইশ! ভুলেই গেছিলাম আর হাঁটু মুড়ে বসতেই পারি না প্রায়। না হলে জুনিয়র ভার্সেস সিনিয়রদের একটা খো খো ম্যাচ করতে বলতাম।

অপরাজিতা মিত্রঃ আমরা প্রচুর ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতাম। আমি, সোমা, নীলাঞ্জনা, অনিন্দিতা... খুব মজা হতো। উঠোনের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ছুটে কেউ হয়তো বারান্দায় উঠে পড়েছে। তাকে তো ধরতে হবে।  তখন বারান্দায় উঠতে গিয়ে কত যে পা স্লিপ করেছি তার ইয়ত্তা নেই! উঠোন খরখরে আর বারান্দা মসৃণ।

প্রমিতা মৈত্রঃ আরও খেলা ছিল। মানিকজোড়, রুমাল চোর। বসে বসে খেলাও ছিল, যেমন কান ফিসফিস।

চান্দ্রেয়ী লাহিড়ীঃ বসে বসে খেলায় আমরা বেশি খেলতাম চোর-পুলিশ-বাবু-ডাকাত। আর ফুল-ফল-নাম-দেশ।

সুর্যাণী দেবঃ আমার পড়ে গিয়ে দাঁত ভেঙেছিল। ঠিক দশ বছর বাদে টি সি এস জয়েন করার এক মাস আগে যেটা এমন ট্রাবল দিয়েছিল যে বাবা মার সঙ্গে নিজের নামও ভুলে গেছিলাম।

মৌমিতা ব্যানার্জীঃ আমরা প্রায় গোটা সেকশন মিলে উঠোনের মাঝখানে খেলতাম হাম চিজ আর ও পিলাস্বাভাবিকভাবেই অতজনের একসঙ্গে ক্ল্যাপ করা সম্ভব হতো না। আর সেটাই মজার হয়ে দাঁড়াত।

No comments:

Post a Comment