৫নং নিবেদিতা লেন। সরুর তস্য সরু এক গলির মধ্যে উঠেছে এক
বিশাল সিংহদরজা। অনেকটা প্রাচীন রাজস্থানী কেল্লাগুলোর মতো। রাজসিক সৌন্দর্য। আর
সেই রাজরূপের সঙ্গে সত্ত্ব-ভাবের মিশেল আনতে দরজার মাথায় রয়েছেন হংস চিহ্ন। ওই
দরজাই সুরটি বেঁধে দেয় ঠিক তারে। রজঃ আর সত্ত্বের যুগলবন্দী অনুক্ষণ এই
শিক্ষায়তনে। সেই দরজা দিয়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম ১৯৮৫ সালে। সাথে ফেলে এলাম
আমাদের কিশোরীবেলা।
শুধুই কি নিজেদের কৈশোর পড়ে রইল পিছনে? পড়ে রইল এক
মায়া-জগত। কেমন ছিল সেই জগত? নিবেদিতা- ক্রিস্টিন- সুধীরার হাতে গড়া সেই শিক্ষামন্দির?
উত্তর কলকাতার মধ্য বা নিম্নবিত্ত বাড়ির মেয়েদের শিক্ষিত আদর্শ ভারতীয় নারী গড়ে
তোলার লক্ষ্যে তৈরি সে-ইশকুল ? নিবেদিতার এ-বিষয়ে দ্বিধাহীন বক্তব্য ছিল যে শিক্ষার
প্রথম প্রয়োজন চরিত্রগঠনের জন্য। বৌদ্ধিক বিকাশের দাবী তার পরে। তিনি চেয়েছিলেন
ভারতের মেয়েরা তাঁদের নিজেদের ইতিহাস থেকেই রোল-মডেল বেছে নিন। পদ্মিনী, চাঁদ
বিবি, ঝাঁসির রানী, মীরাবাঈ, রানী ভবানী, অহল্যাবাঈ, পিপেরার সানহাবি, সতী,
সাবিত্রী, সীতা, উমা, গান্ধারীর দেশে যিনি যেমন ধরনের আদর্শ চাইবেন, তাই পাওয়া
যাবে এই ছিল তাঁর ধারণা। তাঁর নিজের স্কুলে তিনি শিক্ষার সঙ্গে ধর্মভাব মিলিয়ে দিতে
চেয়েছিলেন। ১৮৯৮ সালে এই ভাবধারা নিয়ে আমাদের স্কুল শুরু হয়।
সে সময় পৃথিবীর কেউ বিশ্বযুদ্ধের কল্পনাও করেনি। আমেরিকা
যদিও সিভিল ওয়ার-এ রক্তস্নান করে উঠেছে বহুদিন হল। কালোদের দাসত্ব শৃঙ্খল হয়তো ঘুচেছে, বর্ণবৈষম্য ঘুচতে অনেক অনেক বাকি। আফ্রিকাতে ইংরেজরা ঔপনিবেশিক বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। পাশ্চাত্যের
দেশগুলিতে নারীশিক্ষার প্রচলন শুরু হলেও মুলতঃ তার লক্ষ্য তখনো ভাল মা বা ভাল
গৃহিণী তৈরি করাতে। ভারতেও কিন্তু তার আগেই নারীশিক্ষার শুরু হয়ে গেছে। কালীকৃষ্ণ মিত্র বারাসাতে মেয়েদের স্কুল খুলেছেন
১৮৪৭ সালে। সাবিত্রী ফুলে পুণেতে মেয়েদের
জন্যে স্কুল খুলেছেন ১৮৪৮ সালে। তার পরের বছর কলকাতায় বেথুন সাহেবের স্কুল চালু
হয়। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী তার বারো বছর আগেই তাঁর ডাক্তারি শিক্ষা সম্পূর্ণ করে
পূর্ণ দমে প্র্যাকটিস করছেন। তবু আমজনতার ঘুম ভাঙ্গেনি। কলকাতায় তখনও মেয়েদের বই
ছোঁয়ার পাট মূলতঃ ব্রাহ্ম বাড়িতে। রক্ষণশীল হিন্দুদের ধারণা মেয়েরা বই পড়লে বিধবা
হয়। সেই আগল ভাঙ্গার জন্যে প্রয়োজন ছিল সম্পূর্ণ হিন্দু আদর্শে ধর্মীয় বুদ্বুদে
ঘেরা একটি বিদ্যালয় যেখানে কুমারী, বিবাহিতা বা বিধবারা সমান স্বচ্ছন্দ। যেখানে
মেয়ে-বৌ দের পাঠালে তাঁদের বাপ-দাদাদের সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে যায় না। সারদা মায়ের
আদরের খুকি, বিবেকানন্দের ভাবশিষ্যা নিবেদিতা সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করেছিলেন।
নিবেদিতার জীবন নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাটি করলে বোঝা যায় যে তিনি
বিবেকানন্দের একটি সুর নিজের জীবনে ধারণ করেছিলেন। সেটি হল ‘অভীঃ’। সত্যিকারের ভয়শূন্য না হলে একজন একত্রিশ বছরের
শ্বেতাঙ্গিনী মহিলা একাকী একটি বিজিত প্রাচ্য দেশের জন্য সব কিছু দেওয়ার সঙ্কল্প
করে আত্মীয়- পরিজন- স্বদেশ ছাড়তে পারেন? নিজের আজন্ম লালিত জীবনবোধকে বর্জন করে
বিদেশীয় রীতি-নীতিকে আশ্রয় করে পুনর্জন্ম নিতে পারেন? নিজের উপর অসীম বিশ্বাস আর
আস্থা থাকলেই এ পথে এগোন সম্ভব। সেই নির্ভীক আত্মবিশ্বাসের জোরে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিবেদিতা বাগবাজারে
বোসপাড়া লেনে কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতিতে পড়ানোর স্কুল খুলে ফেললেন। এর পরের জীবন
কিন্তু খুব মধুর ছিল না। ১৯০২ সালে স্বামীজী মারা যান। নিবেদিতা ইতিমধ্যে কয়েক বছর
ভারতে বসবাসের ফলে কাছ থেকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কুফলগুলি দেখতে পেয়েছেন এবং তার
বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক কাজকর্মগুলি রামকৃষ্ণ সংঘের যে
অরাজনৈতিক গতিপথ, তার থেকে সম্পূর্ণ অন্য খাতে চলছিল। তার ফলস্বরূপ তাকে সংঘের
থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়। এরপর ধীরে ধীরে স্কুলের রোজকার কাজের ভার কাঁধে তুলে
নিলেন সিস্টার ক্রিস্টিন। নিবেদিতা জড়িয়ে পড়লেন নিজের লেখালেখি, বক্তৃতা এসব কাজে।
অবশ্য স্কুলটি তখনও লোকমুখে পরিচিত সিস্টার নিবেদিতার স্কুল বলেই। ১৯১১ তে
নিবেদিতার প্রয়াণের পরে তাঁর সাধের স্কুলটি রামকৃষ্ণ সংঘের অধীনে আসে। পরে সারদা
মিশন তৈরি হলে সেটি রামকৃষ্ণ সারদা মিশন সিস্টার নিবেদিতা গার্লস স্কুল নামে পরিচিত
হয়।
কাট টু ১৯৮৫। কেমন ছিল তখনকার কলকাতা? এক আশ্চর্য মিশ্রণ
তখন। ততদিনে কলকাতা বিব্রত হয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী উদ্বাস্তুর ভিড়ে। কলকাতা শহরের
গন্ডি ভবানীপুর থেকে শ্যামবাজার ছাড়িয়ে উত্তরে-দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়েছে বহু বহু দূর।
উত্তর কলকাতার বনেদী বাবুরা যেসব বাগানবাড়িতে জমিয়ে মেহফিল বসাতেন, সেসব বেদখল হয়ে
কলোনি উঠেছে। আর সেই সঙ্গে এসেছে একটা বিরাট আর্থসামাজিক বদল। খানিকটা পেটের দায়েই
নিতান্ত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে কর্মজগতে। পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা
করে জিতে নিতে হচ্ছে একটি অমূল্য চাকরির অধিকার। আর সেখানেই কদর বাড়ছে মেয়েদের
প্রথাগত শিক্ষার, যা তাদের কর্মোপযোগী করে তুলবে। উদ্বাস্তু বাড়ির মেয়েরা যেখানে
পরিস্থিতির চাপে অপেক্ষাকৃত বেশি স্বাধীনতা পেয়ে যাচ্ছে, উত্তর কলকাতার বনেদী
বাড়িগুলোর কাছে তখনও রক্ষণশীলতাই পরম ধর্ম। এসব বাড়ির মেয়েরা অনেক জায়গাতেই তখনও
একলা বাড়ির বাইরে পা রাখতে পারেন না। কলকাতা সাক্ষী হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক
আন্দোলনের। নকশাল আন্দোলনের রক্তস্নানস্মৃতি তখনও বিবর্ণ হয়নি। ঢেউয়ের মতো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বদল হয়তো এসব
বাড়ির রক্ষণশীলতার ভিতকে তখন ভিতরে ভিতরে ক্ষইয়ে দিচ্ছে, কিন্তু সে বাইরে থেকে
বোঝা দুঃসাধ্য। সাদা চোখে সে দুর্গের পাঁচিল তখনও অটুট। এই পরিস্থিতিতে সারদা মঠের
অধীন স্কুলটির সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। হয় নতুন যুগের নতুন দাবী মেনে নিজেকে বদলানো অথবা নিজেদের এতদিন ধরে চলে আসা পথ ধরেই চলতে থাকা। নিবেদিতা স্কুল তখন বেছে
নিয়েছিল ট্র্যাডিশনাল পথ। সেই ভিক্টোরিয়ান রীতির আদলে মোড়া শিক্ষানীতি যার মূল
উদ্দেশ্য “ভাল মা, ভাল বৌ” তৈরি করা। উত্তর কলকাতার তৎকালীন মেথুশীলা বঙ্গসমাজ
তাই এই স্কুলকে আদরে কোলে বসিয়ে রাখল।
নাঃ সব মেয়েই কর্মজগতে আসবেন বা কর্মকরী বিদ্যার অনুরাগী
হবেন এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। এমনটা আশা করারও কোনও কারণ নেই যে, যে পটভূমিকায়
একটি বিদ্যালয় তৈরি হয় বা যে আর্থসামাজিক পারিপার্শ্বিকে একটি বিদ্যালয় চালানো হয়,
বিদ্যালয়ের ভাবধারা তার থেকে অনেকখানি আলাদা হবে। তাই তদানীন্তন সমাজের মধ্যে থেকে
সমাজের মধ্যে নারীশিক্ষার চর্চা চালিয়ে যাওয়া যদি লক্ষ্য হয়, আমাদের স্কুল সেদিক থেকে একেবারে সফল। মেয়েদের মধ্যে
বিদ্যাচর্চার আলোটি একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে জ্বালিয়ে রেখে যাওয়া কম কৃতিত্বের কথা
নয়।
আর ইস্কুলের আদর্শ ভাল-মন্দ যাই হোক না কেন, আমাদের স্কুলের
শিক্ষিকারা অনেকেই ছিলেন ছাত্রীগতপ্রাণ। অসীম ভালবাসায় তাঁরা আমাদের ভরিয়ে রাখতেন।
শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, নিজের নিজের জীবনযাপন দিয়ে এঁরা আমাদের শৈশব-কৈশোর
পরিচালনা করেছেন। নিবেদিতা যে সলতেটি জ্বালিয়েছিলেন, এঁরা অনেক যতনে সেই শিখাটিকে
ঝোড়ো হাওয়ার থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এঁদের কথা মনে করলে আজও শ্রদ্ধায় মাথা নিচু
হয়ে যায়। আর অন্যান্য বিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করলে এই বিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতা, নিয়মানুবর্তিতা,
পাঠদানের মান আর সামগ্রিক উৎকর্ষ আশেপাশের সব স্কুলের কাছে ঈর্ষার বিষয়। স্কুলের সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানের সুর যে তারে বাঁধা থাকত, পরবর্তীকালে অনেক পেশাদারী অনুষ্ঠানের মানও
দেখেছি তার ধারেকাছে পৌঁছয়নি।
তবে সেই কৈশোরে ধারণা ছিল, এই স্কুল যতখানি সারদা মঠের স্কুল,
ঠিক ততখানিই নিবেদিতার স্কুলও। সেই
নিবেদিতা, যিনি সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্তে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে চলে
এসেছিলেন ভারতবর্ষে, শুধুমাত্র নিজের স্বপ্নকে অনুসরণ করে। সেই নিবেদিতা যিনি
প্রাণের চেয়েও প্রিয় মঠের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন শুধু নিজের
রাজনৈতিক কাজকর্মের স্বাধীনতা রক্ষার তাগিদে। সেই নিবেদিতা যার কাছে কিন্তু তখনকার
হিন্দু সমাজের মেয়েদের স্বাভাবিক পর্দাপ্রথার চেয়ে ব্রাহ্ম মহিলাদের স্বাধীনতা অনেক
বেশি বরণীয় ছিল। নিবেদিতা তো তখনকার সমাজের বদ্ধ জলাশয়ে ঘূর্ণি তুলেছিলেন মেয়েদের
স্কুল চালু করে। তাহলে তাঁর হাতে গড়া স্কুল কেন আশি বছর পরেও পুরনো আদর্শ ধরে বসে
থাকবে? নতুন যুগের আত্মবিশ্বাসী মেয়ের প্রয়োজন দেশের, যার মাতৃপরিচয় বা বধূপরিচয়
ছাপিয়ে উঠবে নিজস্ব পরিচয় - তাদের গড়ে তোলার কাজে অগ্রণী হবে আমাদের আদরের
নিবেদিতা স্কুল – এ আশা কি আশির দশকে বড্ড
বেশি আশা ছিল?
নিবেদিতার মনন, বুদ্ধি এবং সহজাত নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা
তাঁকে চালিকার আসনে বসিয়েছিল। তিনি কিন্তু সহজেই বুঝেছিলেন প্রত্যেকটি মানুষ
একরকমের হবে না। তাই সীতা, সাবিত্রী, মীরা বাঈ এর আদর্শের পাশাপাশি লক্ষ্মী বাঈ,
রানী ভবানীরও প্রয়োজন আছে। অথচ স্কুলে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীতে গীতাপাঠ বাধ্যতামূলক
হলেও আর দ্রুত পঠনের দৌলতে সীতার কাহিনী কণ্ঠস্থ হলেও অন্য নারীদের নিয়ে সমানুপাতিক
আলোচনা তেমন একটা শুনিনি। আমাদের বিদ্যালয়ের স্বাধীনতা দিবস যাপনের অনুষ্ঠানটি
অনবদ্য, অতুলনীয়। প্রতিটি সেকশনের মেয়েদের অসীম যত্নে তৈরি করা চার্টে সাজানো টানা
বারান্দায় বসে যে একবার সেই বন্দে মাতরমের সুর শুনেছে সেই বোধহয় দেশমাতৃকার
একনিষ্ঠ পূজারীতে পরিণত হয়েছে। তবু প্রশ্ন জাগে সেই নিবেদিতার স্কুলে কোনও বয়সোচিত
বিদ্রোহী আচরণকেই ক্ষমার চোখে না দেখে একেবারে রোড-রোলার দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া হতো
কেন? ব্যক্তিগত ধারণা বলে, আমাদের ইশকুলের অন্তত সেই আশির দশকের মেয়েদের সাহিত্য
বা সাংস্কৃতিক জ্ঞান বা ধর্মাচারবোধ যতটা
প্রখর, সমাজনৈতিক জ্ঞানের বিভাটি ততটা প্রবল নয়। এটি যদিও ব্যক্তিগত
স্বাচ্ছন্দ্যের দ্যোতক, তবু মনে হয় সামগ্রিক যে ছবিটি ফুটে ওঠে, তা কি কিছুটা হলেও
বিদ্যালয়ের আদর্শের ঝোঁকটা তুলে ধরে না? যে নিবেদিতার সমাজবোধ তাঁর জীবনের
চালিকাশক্তি ছিল, তাঁরই হাতে-গড়া স্কুলে এটি দেখলে দুঃখ লাগে বৈ কি!
নিবেদিতার গুরু বিবেকানন্দ বলেছিলেন ধর্মচর্চার চাইতে ফুটবল
খেলা ভাল। তাঁরই শিষ্যা নিবেদিতার নামাঙ্কিত স্কুলে শারীরচর্চা এতই অবহেলিত ছিল (অন্তত সেই ৮০-৮৫ সালে) যে পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণীর সবার খেলাধুলার জন্যে শুধু
একটিই বাঁধানো চাতাল ছিল । তারা তবুও ভাগ্যবান
ছিল – প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণীর অতগুলি
ছাত্রীর জুটত শুধু একটি ঢাকা ছাদ। স্কাউট ইত্যাদি আমাদের স্কুলে অকল্পনীয় ছিল।
নামী পাহাড়ু প্রাণেশ চক্রবর্তীর সঙ্গে বিদ্যালয়ের কিছু ব্যক্তিগত সম্পর্কের জোরে
হাতে গোনা কয়েকটি মেয়ে তখন রক-ক্লাইম্বিং কোর্সে যাওয়ার সুযোগ পেত। পরে অবশ্য
ক্লাস নাইনের এক্সকারশনেও সে সুযোগটি দেওয়া হতো। কিন্তু রোজকার খেলাধুলোর বন্দোবস্তের তখনও কোনও বদল হয়নি। তখনকার সমাজের নিয়ম
মেনে মেয়েদের শেখানো হয়েছে পুরুষদের থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে। কিন্তু আত্মরক্ষার
উপায় শেখানো হয়নি। তখন মনে হয়েছে নিবেদিতা নিজে কি এই নিয়ম মেনে চলতেন? তাহলে তো
স্বামীজীর সঙ্গে তাঁর আর দেখাই হতো
না! অবন ঠাকুর, নন্দলাল বসুদের সঙ্গ যদি পুরুষ জ্ঞানে ত্যাগ করতেন, তাহলে কি আর “অজন্তা” লেখা
হতো? আরও মন খারাপ হয়েছে সিদ্ধান্তের
দ্বিচারিতা দেখে। একদিকে শুনেছি আমাদের স্কুল চারিত্রিক গঠনের আদর্শকে সবার উপরে
জায়গা দেয় – বৌদ্ধিক
উৎকর্ষ বিধানের স্থান অনেক পরে। অথচ অষ্টম শ্রেণী
থেকে নবম শ্রেণীতে উঠতে সে সময় এক রাশ মেয়ে মুখ ম্লান করে বিদায় নিত – তারা আপাতদৃষ্টিতে বিদ্যালয়ের পঠন পাঠনের মানের
উপযোগী নয়। কৈশোরের বুদ্ধিতে বুঝতে অসুবিধা হয়েছে এই দুটি আদর্শ বা সিদ্ধান্ত
কিভাবে এক বিন্দুতে মেলে। কষ্ট পেতে হয়েছে মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিক্ষিকার ভয়ানক
পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবহারে । বার বার মনে হয়েছে এ ব্যবহার তো ওই
উজ্জ্বল, আত্মবিশ্বাসী, শুভ শক্তিতে ভরপুর মানুষটির সঙ্গে যায় না!
আগেও বলেছি আমাদের
ইশকুল ভালো, অন্য অনেক স্কুলের থেকে অনেকখানিই বেশি ভালো- সে কথা সবাই জানে, কিন্তু আমরা চেয়েছি আরও ভালো, আরও ভবিষ্যৎদর্শী আদর্শ। স্কুলই শিখিয়েছে ক্রমাগত নিজেকে
ভালোর থেকে ভালো করতে হবে। সে কথা তো স্কুলের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।
স্কুল ছেড়েছি বহু বছর।
আজ বহু বছরের দুনিয়াদারির পরে একটা কথাই বুঝি। একটি প্রতিষ্ঠান একটি বহতা নদীর
মতন। ভগীরথ যেমন গঙ্গাকে মর্ত্যে এনেছিলেন, তেমনি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিবেদিতা এ পোড়া দেশের
রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে নারী শিক্ষার ধারাটিকে বয়ে এনেছিলেন। তাঁর প্রয়াণের পরে সেই
সরু জলধারা আরও বহুজনের অবদানে তিলে তিলে পূর্ণতার দিকে এগিয়েছে। ১৮৯৮ সালে ক’টি বালিকার হাত ধরে সে বিদ্যালয়ের
সূচনা, আজ সে এক বিশাল প্রতিষ্ঠান। এই উত্তরণে নিবেদিতার অবদান আগমনীর শঙ্খধ্বনির মতো হলেও তাঁর উত্তরসূরীদের প্রত্যেকের অবদানও অসীম। সবার স্নেহে-মমতায় গড়া যে
প্রতিষ্ঠান, সে তো আর শুধুমাত্র একজনের ব্যক্তিত্বের, মননের ছোঁয়ায় উজ্জ্বল থাকতে পারে না। সবার ব্যক্তিত্ব, সবার ভাবধারাকে বিন্দু বিন্দু আহরণ
করেই আজকের বিদ্যালয়ের চরিত্রটি তৈরি হয়েছে। তাই বিদ্যালয়ের প্রতিটি কাজে
নিবেদিতার ছোঁয়া খোঁজার চেষ্টা করা অর্থহীন।
তবু নিবেদিতা আছেন।
আছেন তাঁর তৈরি করে যাওয়া স্কুলের প্রবেশপথের সামনের ছবিতে। নিরাভরণ, সাদা গাউনে, আত্মবিশ্বাসী, উজ্জ্বল চাহনিতে। আর আছেন তাঁর
বিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রীর মনে। রোল মডেল খুঁজতে আমাদের আর পুরাণ–ইতিহাস ঘাঁটতে হয় না। আমাদের জন্য
তিনি আছেন। মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল।
"কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা" ।।
স্বাতী রায় [১৯৮৫]
proti ti shobder sathe ek mot , tar sathe etao mone hoye utsahee chhatree der kakukola chorcha r joto ta sujog ba proshongsha prapyo hoto bigyan chorcha korte chawa meye gulo r khetre seta jutto na
ReplyDeleteEkdike jemon onek purono smriti bhir kore elo onno dike temon i kichu jugoupojugi kotha ja bohubar bolte cheyeo bola hoye otheni!! khub bhalo laglo re Swati.
ReplyDeleteOnekdin dhore nijer kotha k rup dite parchilam na se poth kichuta sugam holo..
ReplyDeleteতথ্যনিষ্ঠ, সিন্সিয়ার লেখা। খুব ভাল লেগেছে। :)
ReplyDeleteখুব সুন্দর।
ReplyDeleteখুব সঠিক ও পক্ষপাতহীন লেখা...একেবারে যুগোপযোগী
ReplyDelete