আচ্ছা আইসক্রিম খেতে কে না ভালোবাসে? ছেলে, মেয়ে, বাচ্চা, বুড়ো আইসক্রিম দেখলে প্রাণের ভেতরটা ঠান্ডা হয় না এমন কেউ আছে না কি! ইয়ে... মানে, আমি আছি। অন্তত এক কালে ছিলাম। ছোটবেলায় আইসক্রিম মানে ছিল কাপে পাথরের মতো শক্ত একটা ঢেলা আর নয়ত কাঠিতে রংবেরঙ্গের বরফ। কাঠি আইসক্রিম বা পেপসি খেতে দারুণ লাগত কিন্তু বাজারে রটনা ছিল ওগুলো নর্দমার জল থেকে তৈরি হয়! সুতরাং যতই সাধ থাকুক না কেন যাদের নাম নিতে নেই তাদের ভয়ে খাওয়াই হত না বেশি। আজ থেকে প্রায় বছর পনেরো আগে এই ছবিটা পাল্টে গেলো হঠাৎ করে। বাজারে এল বাস্কিন-রবিনস, কোয়ালিটি ওয়াল্স ইত্যাদি কোম্পানি, আমেরিকান স্টাইল আইসক্রিম নিয়ে। মাখনের মতো তুলতুলে আইসক্রিম, মুখে দিলেই গলে যায় এতটাই আদুরে আর ফ্লেভারের তো কথাই নেই। চকোলেট আর ভ্যানিলার বাইরে যে আরো কত কিছুর আস্বাদ পাওয়া যেতে পারে আইসক্রিমের মধ্যে দিয়ে শিখতে শুরু করলাম আমরা। আর যেই শেখার পালা শুরু হল, আমাদের চাহিদাও বাড়তেই লাগল। এর পর এল মাম্মা মিয়া আর জেলাতো, ইতালীয় আইসক্রিম নিয়ে। সত্যিকারের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা। কোমল যে আরো কত কোমল হতে পারে, কিটকিট ছাড়াও মিষ্টি হতে পারে, ক্রিম বা দুধ ছাড়াও আইসক্রিম হতে পারে জেনে ডুবে গেলাম আমরা, ঐ অতলান্তিক অভূতপূর্ব স্বাদে।
আইসক্রিমের ইতিহাস কিছু না হোক প্রায় তিন-চার হাজার বছরের পুরনো তো হবেই। প্রাচীন পারস্য এবং রোম সাম্রাজ্যে ফল, ফলের রস এবং জাফরান ইত্যাদি নানা ভেষজ সুগন্ধী বরফের কুচির সাথে মিশিয়ে খাওয়ার প্রচলন ছিলো। প্রাচীন চিনে শোনা যায় দুধ এবং ভাত মিশিয়ে বরফে জমানো একধরণের মিষ্টির কথা. প্রথম চীনারাই আবিষ্কার করেন যে নুন যেভাবে জলের স্ফুটনাঙ্ক বাড়িয়ে দেয় ঠিক সেভাবেই শৈত্যাঙ্ক কমিয়ে দেয় শূন্যের তলায়। চীনেই শোনা যায় প্রথম আবিষ্কার হয়েছিল আইসক্রিম তৈরীর যন্ত্র। বলা হয়ে থাকে পাস্তার মতো আইসক্রিমের রহস্যও চীন থেকে ইতালিতে নিয়ে আসেন মার্কো পোলো। তবু প্রথম বানিজ্যিক ভাবে আইসক্রিম তৈরি এবং বিক্রি শুরু করেন আরবরা। এরাই প্রথম আইসক্রিমে দুধ এবং চিনি মেশানোর প্রচলন শুরু করেন। রাজকীয় পরিবারগুলিতে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে আইসক্রিম। কিন্তু তখনো সাধারণ মানুষের নাগালে আসেনি এই সুখাদ্য, আরো অনেক কিছুর মতই। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই এই ছবিটা পাল্টাতে শুরু করে। ক্রমশ জনপ্রিয় এবং সহজলভ্য হয়ে উঠতে থাকে আইসক্রিম। প্রকারভেদ তৈরি হতে থাকে, প্রণালীতে পরিবর্তন এবং উন্নতি উভয়ই আসতে থাকে। চিরাচরিত ফলের সরবেট বা জমাট দুধের পিন্ড নয় আস্তে আস্তে তৈরি হতে থাকে আইসক্রিম সানডে, আইসক্রিম সোডা ইত্যাদি। বিংশ শতকে আইসক্রিম ব্যবসার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সম্ভবত আইসক্রিম ফেটানোর সময় বাতাসের মাত্রা বৃদ্ধি করা। তৈরি হল সফট সার্ভ আইসক্রিম বা সফটি। ফেটানোর সময় বাতাসের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়াতে আইসক্রিম পরিমাণে যেমন বেড়ে গেল তেমনি খেতেও হল আরো নরম, হালকা। ফলে এর জনপ্রিয়তা বাড়লো বহুগুণে। তবে সব চাইতে লাভের মুখ দেখলেন প্রস্তুতকারকরা। কেননা ফুলেফেঁপে আইসক্রিমে আসল উপাদানের (যথা ফল, ফলের রস, দুধ ইত্যাদি) মাত্রা কমে গেল প্রচুর পরিমাণে। এই বাতাসের মাত্রার হেরফেরেই ইতালীয় আইসক্রিম জেলাতো, আমেরিকান আইসক্রিমের চাইতে অনেক বেশি ঘন, পেলব এবং যাকে বলে ইন্টেন্সলি ফ্লেভার্ড। জেলাতোতে বাতাসের মাত্রা যেখানে ২০% সেখানে আমেরিকান আইসক্রিমে বাতাসের মাত্রা ৬০-৮০%।
আইসক্রিম তো আছে অনেক রকমের। আমি আজ কথা বলবো ঘরে হাতে ফেটিয়ে তৈরি করা সম্ভব এমন কিছু আইসক্রিম নিয়ে যেমন সেমিফ্রেদো, সরবেট, গ্রানিতা, কুলফি, ফ্রো-ইয়ো ইত্যাদি।
প্রথমে সেমিফ্রেদো: ইতালীয় ভাষায় এর অর্থ অর্ধেক জমাট। এর প্রণালী অনেকটাই মেলে ফরাসী আইসক্রিম গ্লেস এর সঙ্গে। এতে লাগে ক্রিম, ডিমের কুসুম, চিনি(আইসিং/ক্যাস্টর সুগার) আর পছন্দ মতো ফ্লেভারিং এজেন্ট যেমন, ভ্যানিলা বা অন্য কোনো নির্যাস, কোকো, ফলের রস ইত্যাদি। চিনিটাকে দুভাগে ভাগ করে এক ভাগ ক্রিমের সাথে আর এক ভাগ ডিমের কুসুমের সাথে ফেটিয়ে নিতে হবে যতক্ষণ না সফ্ট পিক তৈরী করে। এবারে এই দুটো ভাগকে একসাথে মিশিয়ে নিয়ে তার সাথে ওই ফ্লেভারিং এজেন্ট মেশাতে হবে। সবটা এক সঙ্গে মিশিয়ে একটা পাত্রে ঢেলে কম করে পাঁচ ঘন্টা জমাতে হবে। চাইলে এতে একটু পছন্দ মতো অ্যালকোহলও মেশানো যায়। আমি বানিয়েছিলাম পিনা কোলাডা আইসক্রিম। ৫০০ মিলি ক্রিমের সাথে এক কাপ চিনি মিশিয়ে ফেটিয়ে নিয়েছিলাম। আর ১০টা ডিমের কুসুমের সাথে এক কাপ চিনি দিয়ে ফেটিয়ে নিয়েছিলাম। এবারে এই দুটো ভাগ কে এক সঙ্গে মিশিয়ে এতে ২০০ মিলি আনারসের রস আর ২০০ মিলি নারকেলের ঘন দুধ মিশিয়ে ভালো করে ফেটিয়ে নিয়েছিলাম। গোটা মিশ্রণটাকে দুভাগে ভাগ করে একটা তখনি জমাতে বসিয়ে দিই। আর একটাতে এক পেগ সাদা রাম মিশিয়ে জমাতে দিই। একইসঙ্গে একই আইসক্রিমের দুটো রকম তৈরি।
ছবি: পিনা কোলাডা আইসক্রিম
এবারে সরবেট: পছন্দমতো যেকোনো ফলের সাথে চিনির রস বা মধু বা যেকোনো মিষ্টি সিরাপ মিশিয়ে ব্লেন্ডারএ জোরে মিশিয়ে নিন। এবারে এটা সারারাত ফ্রিজে রেখে জমিয়ে নিন।
গ্রানিতার ক্ষেত্রে প্রণালীটা উল্টো। এক কাপ জল আর আধ কাপ চিনি মিশিয়ে চিনির রস তৈরি করে নিন। এটা ঠান্ডা হলে এতে ইচ্ছা মতো ফলের রস, স্কোয়াশ বা সফট ড্রিঙ্ক মিশিয়ে ফ্রিজে জমতে দিন। আধ ঘন্টা বাদে বাদে একটু জমে এলেই কাঁটা চামচ দিয়ে পুরোটা কুরে দিন। পুরোটা কেলাসিত হয়ে গেলেই মানে জমে গেলেই গ্রানিতা তৈরি।
ছবি: গ্রানিতা - বেদানা ও চেরী, কোলা, ম্যাঙ্গো এবং লেমন-মিন্ট
ভারতীয় কুলফির ক্ষেত্রে দুধ ফুটিয়ে ঘন করে নেওয়া হয়। সাধারণ ভাবে ঘন করার সময় এলাচ গুঁড়ো মেশানো হয়ে। দুধ ঘন হয়ে এলে এতে চিনি মেশানো হয়। এবারে এই মিশ্রণটি ঠান্ডা হলে এতে ফলের ক্কাথ (পাল্প) বা বাদামের গুঁড়ো মিশিয়ে জমানো হয়।
আজকাল স্বাস্থ্যের কারণে অনেকেই আইসক্রিমের বদলে পছন্দ করছেন ফ্রোজেন ইয়োগার্ট সংক্ষেপে ফ্রো ইয়ো। কিছুই না দুধ এবং চিনির বদলে জল ঝরানো দইয়ের সাথে ফ্লেভারিং এজেন্ট মিশিয়ে জমানো হয়। কিছুক্ষণ পর পর একবার করে ঘেঁটে দিতে হয়। চিনির বদলে ফলের স্বাভাবিক মিষ্টতা বা মধুর উপর নির্ভর করা হয়।
এছাড়াও বাড়িতে বানানো যেতে পারে নানারকম আইসক্রিম ফ্লোট বা সানডে।
ফ্লোট এর জন্য একটা লম্বা গ্লাসে আইসক্রিম নিন। এর উপরে পছন্দসই পানীয় ঢালুন। ভ্যানিলা আইসক্রিমের সাথে কোকাকোলা, ফানটা, আম পান্না, কফি ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে। ঠান্ডা কফির সাথে চকোলেট বা বাটারস্কচ আইসক্রিম চলতে পারে। বাচ্চাদের জন্য দুধের সাথে এক স্কুপ আইসক্রিম আর দু চামচ জ্যাম মিশিয়ে তৈরি করা যেতে পারে। এক বার ফ্লেভার কম্বিনেশনটা বুঝে গেলে এটা বানানো সব চাইতে সোজা।
সাধারনভাবে সানডে বানাতে হলে আমি ফল ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিই আর আর একটু লোভনীয় করতে হলে সেগুলো মাখনে ভেজে নিই। এবারে বাটিতে আইসক্রিম দিয়ে ওতে ফলের টুকরো, নানা রকম বাদামের টুকরো, কুকি বা কেকের ক্রাম্ব, কিশমিশ বা এপ্রিকটের টুকরো ইত্যাদি মিশিয়ে উপর থেকে চকোলেট, স্ট্রবেরি বা বাটার স্কচ সিরাপ ঢেলে দিই। কখনো কখনো স্কোয়াশ বা ক্রাশও দিই।
ছবিঃ বানানা স্প্লিট সানডে
অনেক বকবক হল, এবার চট করে বানিয়ে ফেলুন দিকি। গরমটাকে খানিক বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আনন্দ করে নিই।
তনুশ্রী মুস্তাফি
১৯৯৮
asadharon....
ReplyDeleteei recipe ekdom must try.. tobe chobir gulo to jemon lov lagar moto, temonti hoibe na
ReplyDeleteMoteo na. Dibbyi hobe. :)
Deleterecipe je bhalo se niye sondeho nei karor... tobe tar cheyeo bhalo legeche tanusreer galpo bolar style ta :) erakom lekha aro asuk...
ReplyDeletejust yummies.. introduction ar unique narrating style article ta aro intersting koreche..golper sathe sathe ice cream er gondho niye besh chete pute recipe gulo neoa galo..'Ranna-banna' section a sob e dekhchi amar favorite dishes :) :)
ReplyDeleteei naa hole ranna-banna ! Shudhu dudh-chini meshalei hobe ? Bujhte hobe naa ranna o aykta shilpo?Taar o prochur itihaas,bhugol,biggyan sab aachhe ! Ice-cream gulo to botei,sab miliye khoob bhalo kaaj Tanusree :-)
ReplyDeleteranna ke ekta shilpe porinato kora jaay.. seta or album dekhle to bojha jay i.. ekhon or lekha poreo seta malum hoy.. ki bol? :)
DeleteAmi bektigatobhaabe ranna korte o khete bhalobasi. Tai jaani poribeshon er dakkhota onek somoy ei bhalo ranna/khabar er swad bariye daye. Khoob gorib manushder haate bhalo rannao kheyechhi prochur.Kintu bhalo rNadhuni'r baktobbyo sab khetrei ayk - bhalobese korle bhalo hobe. Tanusree o'r bhalobasa ke ekhane besh sundor kore poribeshon korechhe. Noito sab ranna-rosik raai jaane taara kato baro shilpi ;-).
Deleteami ice cream khete pari na..kintu pore khub anondo holo!!
ReplyDeletekeno baloto? Dairy allergy na daant? prothomerta upay ache kintu sesherta hole tomar jannyo anek sahomormita roilo. Chesta korbo annyo kichu idea deoar. :)
Delete