ইসার সঙ্গে আমার প্রথম
দেখা হায়দ্রাবাদ এয়ারপোর্টে। একটা ভারী ব্যাকপ্যাক আর মাঝারি আকারের ট্রলি নিয়ে
এক্সিটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। লাউঞ্জ ভর্তি লোক। কেউ অপেক্ষা করছে, কেউ বাড়ির
লোকদের নিতে এসেছে। এদিক সেদিক দেখছি। এমন সময়ে একটি আফ্রিকান ছেলে
হঠাৎ সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,“বসুন প্লিজ”। আমি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলাম,“না না। ঠিক আছে। আপনি বসুন”। তারপর দু’ চারটে ভদ্রতা আর হাসি বিনিময়ের পর আমি জিজ্ঞেস
করলাম,“কোন দেশ থেকে
এসছেন?” সে বলল,“চাদ!” শুনে আমি বললাম,“আরে চাদ হ্রদের কথা পড়েছি তো ছোটবেলায়! আফ্রিকা নিয়ে আমার
খুব উৎসাহ! খুব যাওয়ার ইচ্ছে। রিখটারজভেল্ট পাহাড়ের কথা তো আমরা সবাই জানি ছোট
থেকে। চাঁদের পাহাড়! মাউন্টেন অফ মুন! আর ইজিপ্ট নিয়েও যে কী রোমাঞ্চ। গিজার পিরামিড, তুতেন খামেনের
সমাধি, নেফারতিতি আর রানি ক্লিওপেট্রার কথা কত পড়েছি! ইথিওপিয়ান কফি ভালবাসি। আফ্রিকান র্যাপ,
হিপ-হপ-জ্যাজ শুনে তো বড় হলাম!” শুনে সে অবাক হয়ে বলল,“তুমি চাদ হ্রদের
কথা জান! তুমি আফ্রিকা নিয়ে এতকিছু জান!” যদিও আমরা ইংলিশে কথা বলছিলাম...তবু
স্পষ্ট মনে হল ও ‘আপনি’ ছেড়ে ‘তুমি’-তে নেমে এসেছে। আমি বললাম,“জানি মানে? একশ বার জানি। লেক চাদ জানি। লেক ভিক্টোরিয়া জানি। যেখান থেকে নীল নদ উত্তরে গিয়ে
ভূমধ্যসাগরে পড়েছে। সুদান-মালি-উগান্ডা-তানজানিয়ার কথা জানি। মাইকেল পালিন-এর “সাহারা” দেখেছি বিবিসি
টিভিতে। গোটা উত্তর আফ্রিকা আমি মনে মনে ঘুরেছি। ‘কোরা’ নামে একটা আফ্রিকান
বাদ্যযন্ত্র আমার খুব প্রিয়। মরক্কো যাওয়ার আমার খুব ইচ্ছে। স্পেন বেড়াতে গেলে একবারে
যাব ভেবে রেখেছি”। ছেলেটার মুখ
উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। “এই তুমি কোথায় থাক?” আমি বললাম,“কলকাতায়। এখানে এক
বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে এসেছি। ওরা নিতে আসবে, তাই দাঁড়িয়ে আছি। আর তুমি?” ও বলল, “আমি এখানে পড়াশোনা
করছি, ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটিতে”। ঠিক তখনই আমার ফোন
বেজে উঠল। আমায় নিতে এসে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম,“ফেসবুকে আছ? দেখ
তো, আমাকে অ্যাড করে নাও”। ও বলল,“তোমার ফোনটা দাও।
আমি খুঁজে দিই। এত বড় নাম আমার, তুমি খুঁজে পাবে না”। দেখলাম, সত্যি বিরাট নাম। ইসা সালেহ্ ইসা দাউকারদা। অ্যাড
করে নিলাম। নিয়েই দৌড়লাম গেটের দিকে। তারপর আবার ফিরে এসে ইসাকে বললাম,“বাইরে চল একবার।
পুলিশ আমার বন্ধুকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। একটা ছবি তুলব একসাথে”। ইসা হাসতে হাসতে বাইরে এল। ছবি উঠল। সেদিন রাতেই সে ছবি
ফেসবুকে পোস্ট হয়ে গেল। লিখলাম,“This world is full of love only if you are ready to live it”. প্রচুর লাইক আর কমেন্ট পড়ল ছবিতে। আফ্রিকা-ইন্ডিয়া দু’ তরফেই।
‘অতিথি দেবো ভব’
ইসা আমাকে মেসেজ করল, ফেসবুকে। লিখল,“থ্যাঙ্ক ইউ ফর এভরিথিং। তুমি কতদিন আছ
হায়দ্রাবাদে? যাওয়ার আগে একদিন কি দেখা করতে পারি?” আমি লিখলাম,“নিশ্চই...
জানাচ্ছি”। হায়দ্রাবাদ আমি এর
আগেও এসেছি দু’বার। দুবারই ঝটিতি সফর। একবার স্কুলে পড়তে...দক্ষিণ-ভারত
ভ্রমণের অঙ্গ হিসেবে। আর একবার নাটকের শো করতে। ‘রবীন্দ্রভবন’-এ শো সেরে পরদিন
তিন বন্ধু মিলে ‘সালার জং মিউজিয়ম’ গেছিলাম। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে একতলার
অর্ধেকটুকু দেখা শেষ হয়েছিল। আর প্রথমবার বাবা-মা-দিদির সঙ্গে দেখেছিলাম চার
মিনার। পাশের ‘লাডবাজার’ থেকে মিনা করা গালার চুড়ি আর হার কিনেছিলাম মনে আছে।
হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি খাওয়া হয়েছিল। দোসা-উত্তপম আর বড়া। এবারে হাতে একটু
বেশি সময় নিয়ে এসেছি। আছি গাচিবৌলিতে। জায়গাটার নাম ফিনান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্ট।
শহরের পশ্চিম প্রান্তে। নতুন হায়দ্রাবাদ গড়ে উঠেছে এখানে। ঝাঁ-চকচকে অট্টালিকার
সারি। উঁচু-উঁচু হাইরাইজ, চওড়া রাস্তা। আই টি আর ম্যানেজমেন্ট সেক্টরের যাবতীয়
অফিস। উইপ্রো, গুগল, আই বি এম, ইনফোসিস, অ্যাকসেঞ্চিওর,
অ্যামাজন...অনেকটা আমাদের সেক্টর ফাইভের মতো। কিন্তু অনেক বেশি খোলামেলা। চারপাশে
পাহাড় দেখা যায়। ওপরে উজ্জ্বল নীল আকাশ। বাড়িটার খুব কাছেই একটা ঝিল। তার সবুজ জল
ঘিরে প্রচুর গাছের সারি। এপাশে ফাঁকা জমিতে একটা ডোবামতো। সবুজ পানায় ভরে থাকে
সেটা। আলগোছে জল থেকে উঠে আসে মোষের সারি। পনের তলার জানালা দিয়ে কখনও দেখা যায়
নীচে দু’ ডানা ছড়িয়ে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে বিরাট বড় নাম না জানা একটা
পাখি। কী মায়া যেন ঘিরে থাকে সারাটাদিন।
দূরে একটা অফিসবাড়ির সামনের বিশাল পার্কিং লটে সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে।
খেলনার মতো। লাল-নীল-রুপোলি। রাত হলে গোটা শহরটা আলোয় আলো হয়ে থাকে। মন খারাপ হয়ে
আসে এক এক সময়। মনে হয় সারারাত জেগে এই বড় বড় অফিসবাড়িগুলোতে কী এত কাজ করে চলেছে
মানুষ! এদের কি সময় হয় আকাশের এই পাগল করা অ্যাজিওর ব্লু-টার দিকে একটু তাকিয়ে দেখার?
লম্বা লম্বা কাচের শার্সিতে রোদ ফেলে দুপুরগুলো যে নিঃশব্দে উধাও হয়ে যাচ্ছে দিনের
পর দিন...মাসের পর মাস...বছরের পর বছর...এরা টের পায়?
যে রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্সে আমি আছি, সেটা খুব সাধারণ। খুব বিচ্ছিন্ন, নিষ্প্রাণ। যেমন হয়। বড় বেশিরকম কৃত্রিমভাবে সাজানো, গোছানো। কোনও নিজস্বতা নেই। যে কোনও দেশের যে কোনও একটা আধুনিক জনবসতি। মূল শহরটার ধূলিমলিন, জনবহুল, ঘিঞ্জি গলি...তার ইসলামিক স্থাপত্য আর বাজার, তার মানুষজন দেখার জন্য আমার মন উচাটন হতে থাকে। বাড়ির ভেতর গল্প করার পরিবেশ নেই। তাই পাঁচ-ছ’ দিন একরকম বন্দিদশা কাটিয়ে ঠিক করি যে বাইরে বেরোব। একা একাই। বেরিয়ে ভাল লাগে খুব। গায়ে রোদ মাখি। একটা ট্যাক্সি ধরে নিই। বলি চিড়িয়াখানা চলুন। এবার ঠিক করেই এসেছিলাম সময় পেলে একবার ঘুরে আসব। বন্ধুরা বলেছিল সারাদেশ জুড়ে নাকি এমন চিড়িয়াখানা পাওয়া দুষ্কর। এতটাই অন্যরকম। বিশাল বড়! খুব ভেবে, মন দিয়ে, যত্ন করে, বিজ্ঞানসম্মতভাবে বানানো।
যে রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্সে আমি আছি, সেটা খুব সাধারণ। খুব বিচ্ছিন্ন, নিষ্প্রাণ। যেমন হয়। বড় বেশিরকম কৃত্রিমভাবে সাজানো, গোছানো। কোনও নিজস্বতা নেই। যে কোনও দেশের যে কোনও একটা আধুনিক জনবসতি। মূল শহরটার ধূলিমলিন, জনবহুল, ঘিঞ্জি গলি...তার ইসলামিক স্থাপত্য আর বাজার, তার মানুষজন দেখার জন্য আমার মন উচাটন হতে থাকে। বাড়ির ভেতর গল্প করার পরিবেশ নেই। তাই পাঁচ-ছ’ দিন একরকম বন্দিদশা কাটিয়ে ঠিক করি যে বাইরে বেরোব। একা একাই। বেরিয়ে ভাল লাগে খুব। গায়ে রোদ মাখি। একটা ট্যাক্সি ধরে নিই। বলি চিড়িয়াখানা চলুন। এবার ঠিক করেই এসেছিলাম সময় পেলে একবার ঘুরে আসব। বন্ধুরা বলেছিল সারাদেশ জুড়ে নাকি এমন চিড়িয়াখানা পাওয়া দুষ্কর। এতটাই অন্যরকম। বিশাল বড়! খুব ভেবে, মন দিয়ে, যত্ন করে, বিজ্ঞানসম্মতভাবে বানানো।
একা একা ঘুরতে আমার দারুণ লাগে। অন্যরকম মজা।
নিজের মর্জি মতো হাঁটো, ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াও...যা খুশি খাও। যেখানে চাই বস।
যতক্ষণ প্রাণ চায় জিরোও। কেউ তাড়া দেওয়ার নেই। কেউ থামিয়ে দেওয়ার নেই। অনেকটা
হেঁটে হেঁটে আমি ততক্ষণে ঘুরে নিয়েছি প্রাইমেট পার্ক, প্রজাপতি আর তৃণভোজীদের
চত্ত্বর। একটা বড় চাতাল দেখে একটু বসেছি। ফোন বার করে দেখছি কেমন ছবি উঠল...
চারপাশে কালো বোরখা পরা তরুণী আর সাদা জোব্বা-পাজামা-ফেজটুপি পরা তরুণের দল! এমন
সময় ফেসবুকে ইসার মেসেজ। “কী করছ?” আমি বললাম,”এই তো জু-তে। আসবে নাকি?” ও বলল,“বাঃ! যেতেই পারি।
আমার কলেজের কাছে। কিন্তু দেরি হবে। আমার এখনও ক্লাস বাকি”। আমি বললাম, “কুছ পরোয়া নেহি। ধীরেসুস্থে এস। আমি আরও ঘন্টা দুয়েক আছি”।
হাতে সময় আছে দেখে, খেয়েদেয়ে লায়ন আর টাইগার সাফারি সেরে নিলাম আমি। বেরিয়ে দেখি একটা সাইকেলে চেপে ইসা হাজির। জু-এর ভেতরটা এত বড় যে চাইলে কেউ একটা সাইকেল ভাড়া নিয়ে ঘুরতে পারে। আমাকে দেখে একগাল হেসে বলল,“তুমি সাইকেল নাওনি?” বললাম,“নাঃ। আমি হাঁটতে ভালবাসি”। শুনেই সাইকেল জমা দিয়ে আমার পাশে হাঁটতে শুরু করল ইসা। আমি বললাম,“চারটেয় সাফারি শেষ হয়ে যায়। চল আগে লায়ন সাফারি করে নেওয়া যাক। আমারও আর একবার ঘোরা হবে”। টিকিট কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছিল। অনেক ঝোলাঝুলি করে রাজি করানো গেল। অতিরিক্ত মাশুল দিয়ে বাসে উঠেও পড়লাম। শেষ সাফারি বলে চমৎকার ঘোরাল। আগের সাফারিটার চেয়ে অনেক ভাল করে, সময় নিয়ে। সবাই ভাবছে আমি ইসার গাইড। আমিও আর ভাঙছি না যে ও এদেশেই থাকে। ভাবখানা করছি যেন বিদেশি ট্যুরিস্ট। আজ না দেখলে আর সাফারি দেখা হবে না কখনও। বাস্তবিকই তাই। ইসার থেকে যা শুনলাম, চোখ কপালে। আড়াই বছর এ-দেশে আছে, এই প্রথম আজ চিড়িয়াখানায় এসেছে। চার মিনারটা পর্যন্ত যায়নি। অবাক হলাম খুবই। বললাম,“সে কী কথা! ঘরকুনো নাকি? শুধু কলেজ কর আর আফ্রিকান বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দাও? মেলামেশা কর না এখানকার লোকেদের সাথে?” প্রশ্নটা যে খুব সরল মনে করেছিলাম তা’ নয়। কারণ গত কয়েকবছর ধরে, বারবার খবরে উঠে এসেছে আফ্রিকান মানুষজনদের ওপর এদেশের মানুষের অত্যাচার ও অপরাধের কথা। এমনকি কিছুদিন আগে দিল্লির রাস্তায় কয়েকজন আফ্রিকান ছাত্রকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে, সেটাও জানি। ইসা আমার প্রশ্ন শুনে মুখ ভ্যাটকাল। আমি বললাম,“হাউ ইজ ইন্ডিয়া ট্রিটিং ইউ ইসা?” ব্যাস! সেই প্রশ্নের পর আমার আর স্বাভাবিক থাকা হল না।
ইসা বলল,“ভাল লাগে না এখানে। জানি, পড়তে এসেছি। বেশি কিছু আশা করা হয়তো ঠিক না। কিন্তু আমাদের মনে এদেশের একটা অন্যরকম ছবি ছিল জান! আমার বাড়ি থেকে আমিই প্রথম বিদেশে পড়তে এসেছি। অনেক ভাবনাচিন্তা করে আমাকে এখানে ভর্তি করেছিলেন বাবা-মা। কিন্তু এসে দেখলাম আমাদের তো কেউ পছন্দই করে না। যাকে বলে সহ্য করতে পারে না। কলেজে সবাই আমাদের ‘নাইজেরিয়ান’ বলে ডাকে। আমি কতবার ম্যাপ বের করে দেখিয়ে বলেছি ওদের, দেখ এই হচ্ছে নাইজেরিয়া। আর এই এত দূরে আমার দেশ চাদ। আমার বাকি অনেক বন্ধু যারা সুদান, মালি, উগান্ডা থেকে এখানে এসেছে তাদেরও...আমাদের সবাইকে ইন্ডিয়ান ছাত্ররা ‘হেই নাইজেরিয়ান’ বলে ডাকে। এত এত দেশ আফ্রিকায়। এরা কেউ জানেই না!” সত্যি তো! আমাদের যদি কেউ সবসময় ‘হেই বাংলাদেশি’ বা ‘হেই নেপালি’ বলে ডাকে, ভাল্লাগবে? ইসা বলে চলে,“আর এই নাইজেরিয়ানদের জন্য আমাদের হেনস্থারও শেষ নেই। নিজেদের দেশটাকে তো বেচে দিয়েছে। গিজগিজ করছে লোক। দিনরাত দুষ্কর্ম করে বেড়ায়। আর আমাদের মতো সমস্ত আফ্রিকানদের ওপরে তার চোট এসে পড়ে। ‘বোকো হারাম’-এর জন্য তো সারা পৃথিবীতে আমাদের নাম খারাপ হয়ে গেছে!” আমি বললাম,“না না, অতটা ভেবো না। লোকে তফাৎ একেবারে বোঝে না, তাও নয়। নাইজেরিয়ানদের তো দেখলেই বোঝা যায় অন্যরকম। অনেক বেশি লম্বা। তালগাছের মতো ঢ্যাঙা যাকে বলে। আর গায়ের রঙ একদম জলপাই সবুজ মেশানো কালো”। ইসা বলল,“ বাঃ! তুমি এটা দারুণ খেয়াল করেছ তো! কিন্তু সবাই এগুলো বোঝে না। আমাদের দেখলেই ভাবে ড্রাগ পাওয়া যাবে অথবা আমরা সবাই গে। আমি বলছি না গে হওয়াটা কোনও অপরাধ বা খারাপ কিছু। কিন্তু এত জেনারালাইজ করলে তো মুশকিল! এখানে কতবার এরকম ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। একবার কী হয়েছে শোন! এখানে একটা শপিং মলের সামনে আমার বাইকটা পার্ক করতে গেছি। আরেকটা বাইক একটু ধাক্কা লেগে পড়ে গেল। আমার দোষ ছিল না। কারণ সে-ই ঠিক করে পার্ক করেনি। তাও আমি ছেলেটাকে বললাম,‘স্যরি ব্রো’। ছেলেটা কী করল জান! আমাকে তেড়ে মারতে এল। আমি বললাম,‘ঠিক আছে। তোমার যা ক্ষতি হয়েছে বল, আমি দেব’। সে বলে,‘দশ হাজার টাকা দে’। আমি তো হাঁ! বললাম,‘এইটুকু চোটে এত টাকা চাইছ? তাহলে পুলিশের কাছে চল। পুলিশ যদি বলে, তাহলে এই টাকাটা আমি তোমায় দেব’। শুনে সে তখন পালাল”। আমি চুপ করে শুনছিলাম। এই কথাটা শুনে বললাম,“ভাগ্যিস পুলিশের কাছে যাওনি। নাহলে হয়তো কুড়ি হাজার টাকা দিতে হতো”। শুনে ও ঠা ঠা করে হেসে উঠল। বলল,“জানি। আমি যেখানে ভাড়া থাকি, আমার বাইকটা নীচে পার্ক করা থাকে। প্রতিদিন সেটা থেকে তেল চুরি হয়। যত টাকারই ভরাই না কেন, পরদিন সবটা শেষ করে দেয়। এক ফোঁটা তেল রাখে না যে অন্তত পেট্রল পাম্প অবধি নিয়ে যাব। হাঁটিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে হয়। এটা নিয়ে বলতে গেছিলাম পুলিশের কাছে। আমাকে নাস্তানাবুদ করল। বাইকই বেচে দিলাম। পড়তায় পোষাচ্ছিল না আর। তারপর আমার নাইকি আর রিবকের ভাল ভাল জুতো, টি-শার্ট, ট্র্যাকপ্যান্ট সব চুরি করে নিয়েছে। কেচে বাইরে মেলেছিলাম। আমাদের ওখানে এর'ম হয় না। তাই ভাবিনি। কারওর বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে আমাদের শাসায়। কী করব বল! জানই তো আমাদের অবস্থা। পড়তে এসেছি। পড়া শেষ করে ফিরে যেতে চাই। বাড়ি তো ফিরতে হবে”।
![]() |
চিড়িয়াখানার ভেতরঃ লায়ন সাফারি ও অন্যান্য |
হাতে সময় আছে দেখে, খেয়েদেয়ে লায়ন আর টাইগার সাফারি সেরে নিলাম আমি। বেরিয়ে দেখি একটা সাইকেলে চেপে ইসা হাজির। জু-এর ভেতরটা এত বড় যে চাইলে কেউ একটা সাইকেল ভাড়া নিয়ে ঘুরতে পারে। আমাকে দেখে একগাল হেসে বলল,“তুমি সাইকেল নাওনি?” বললাম,“নাঃ। আমি হাঁটতে ভালবাসি”। শুনেই সাইকেল জমা দিয়ে আমার পাশে হাঁটতে শুরু করল ইসা। আমি বললাম,“চারটেয় সাফারি শেষ হয়ে যায়। চল আগে লায়ন সাফারি করে নেওয়া যাক। আমারও আর একবার ঘোরা হবে”। টিকিট কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছিল। অনেক ঝোলাঝুলি করে রাজি করানো গেল। অতিরিক্ত মাশুল দিয়ে বাসে উঠেও পড়লাম। শেষ সাফারি বলে চমৎকার ঘোরাল। আগের সাফারিটার চেয়ে অনেক ভাল করে, সময় নিয়ে। সবাই ভাবছে আমি ইসার গাইড। আমিও আর ভাঙছি না যে ও এদেশেই থাকে। ভাবখানা করছি যেন বিদেশি ট্যুরিস্ট। আজ না দেখলে আর সাফারি দেখা হবে না কখনও। বাস্তবিকই তাই। ইসার থেকে যা শুনলাম, চোখ কপালে। আড়াই বছর এ-দেশে আছে, এই প্রথম আজ চিড়িয়াখানায় এসেছে। চার মিনারটা পর্যন্ত যায়নি। অবাক হলাম খুবই। বললাম,“সে কী কথা! ঘরকুনো নাকি? শুধু কলেজ কর আর আফ্রিকান বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দাও? মেলামেশা কর না এখানকার লোকেদের সাথে?” প্রশ্নটা যে খুব সরল মনে করেছিলাম তা’ নয়। কারণ গত কয়েকবছর ধরে, বারবার খবরে উঠে এসেছে আফ্রিকান মানুষজনদের ওপর এদেশের মানুষের অত্যাচার ও অপরাধের কথা। এমনকি কিছুদিন আগে দিল্লির রাস্তায় কয়েকজন আফ্রিকান ছাত্রকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে, সেটাও জানি। ইসা আমার প্রশ্ন শুনে মুখ ভ্যাটকাল। আমি বললাম,“হাউ ইজ ইন্ডিয়া ট্রিটিং ইউ ইসা?” ব্যাস! সেই প্রশ্নের পর আমার আর স্বাভাবিক থাকা হল না।
ইসা বলল,“ভাল লাগে না এখানে। জানি, পড়তে এসেছি। বেশি কিছু আশা করা হয়তো ঠিক না। কিন্তু আমাদের মনে এদেশের একটা অন্যরকম ছবি ছিল জান! আমার বাড়ি থেকে আমিই প্রথম বিদেশে পড়তে এসেছি। অনেক ভাবনাচিন্তা করে আমাকে এখানে ভর্তি করেছিলেন বাবা-মা। কিন্তু এসে দেখলাম আমাদের তো কেউ পছন্দই করে না। যাকে বলে সহ্য করতে পারে না। কলেজে সবাই আমাদের ‘নাইজেরিয়ান’ বলে ডাকে। আমি কতবার ম্যাপ বের করে দেখিয়ে বলেছি ওদের, দেখ এই হচ্ছে নাইজেরিয়া। আর এই এত দূরে আমার দেশ চাদ। আমার বাকি অনেক বন্ধু যারা সুদান, মালি, উগান্ডা থেকে এখানে এসেছে তাদেরও...আমাদের সবাইকে ইন্ডিয়ান ছাত্ররা ‘হেই নাইজেরিয়ান’ বলে ডাকে। এত এত দেশ আফ্রিকায়। এরা কেউ জানেই না!” সত্যি তো! আমাদের যদি কেউ সবসময় ‘হেই বাংলাদেশি’ বা ‘হেই নেপালি’ বলে ডাকে, ভাল্লাগবে? ইসা বলে চলে,“আর এই নাইজেরিয়ানদের জন্য আমাদের হেনস্থারও শেষ নেই। নিজেদের দেশটাকে তো বেচে দিয়েছে। গিজগিজ করছে লোক। দিনরাত দুষ্কর্ম করে বেড়ায়। আর আমাদের মতো সমস্ত আফ্রিকানদের ওপরে তার চোট এসে পড়ে। ‘বোকো হারাম’-এর জন্য তো সারা পৃথিবীতে আমাদের নাম খারাপ হয়ে গেছে!” আমি বললাম,“না না, অতটা ভেবো না। লোকে তফাৎ একেবারে বোঝে না, তাও নয়। নাইজেরিয়ানদের তো দেখলেই বোঝা যায় অন্যরকম। অনেক বেশি লম্বা। তালগাছের মতো ঢ্যাঙা যাকে বলে। আর গায়ের রঙ একদম জলপাই সবুজ মেশানো কালো”। ইসা বলল,“ বাঃ! তুমি এটা দারুণ খেয়াল করেছ তো! কিন্তু সবাই এগুলো বোঝে না। আমাদের দেখলেই ভাবে ড্রাগ পাওয়া যাবে অথবা আমরা সবাই গে। আমি বলছি না গে হওয়াটা কোনও অপরাধ বা খারাপ কিছু। কিন্তু এত জেনারালাইজ করলে তো মুশকিল! এখানে কতবার এরকম ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। একবার কী হয়েছে শোন! এখানে একটা শপিং মলের সামনে আমার বাইকটা পার্ক করতে গেছি। আরেকটা বাইক একটু ধাক্কা লেগে পড়ে গেল। আমার দোষ ছিল না। কারণ সে-ই ঠিক করে পার্ক করেনি। তাও আমি ছেলেটাকে বললাম,‘স্যরি ব্রো’। ছেলেটা কী করল জান! আমাকে তেড়ে মারতে এল। আমি বললাম,‘ঠিক আছে। তোমার যা ক্ষতি হয়েছে বল, আমি দেব’। সে বলে,‘দশ হাজার টাকা দে’। আমি তো হাঁ! বললাম,‘এইটুকু চোটে এত টাকা চাইছ? তাহলে পুলিশের কাছে চল। পুলিশ যদি বলে, তাহলে এই টাকাটা আমি তোমায় দেব’। শুনে সে তখন পালাল”। আমি চুপ করে শুনছিলাম। এই কথাটা শুনে বললাম,“ভাগ্যিস পুলিশের কাছে যাওনি। নাহলে হয়তো কুড়ি হাজার টাকা দিতে হতো”। শুনে ও ঠা ঠা করে হেসে উঠল। বলল,“জানি। আমি যেখানে ভাড়া থাকি, আমার বাইকটা নীচে পার্ক করা থাকে। প্রতিদিন সেটা থেকে তেল চুরি হয়। যত টাকারই ভরাই না কেন, পরদিন সবটা শেষ করে দেয়। এক ফোঁটা তেল রাখে না যে অন্তত পেট্রল পাম্প অবধি নিয়ে যাব। হাঁটিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে হয়। এটা নিয়ে বলতে গেছিলাম পুলিশের কাছে। আমাকে নাস্তানাবুদ করল। বাইকই বেচে দিলাম। পড়তায় পোষাচ্ছিল না আর। তারপর আমার নাইকি আর রিবকের ভাল ভাল জুতো, টি-শার্ট, ট্র্যাকপ্যান্ট সব চুরি করে নিয়েছে। কেচে বাইরে মেলেছিলাম। আমাদের ওখানে এর'ম হয় না। তাই ভাবিনি। কারওর বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে আমাদের শাসায়। কী করব বল! জানই তো আমাদের অবস্থা। পড়তে এসেছি। পড়া শেষ করে ফিরে যেতে চাই। বাড়ি তো ফিরতে হবে”।
এই শেষের কথাটা যখন হচ্ছে, আমরা তখন একটা বিশাল অ্যাভিয়ারির সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু
আমার আর কোনওদিকে চোখ নেই। মন নেই। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি। ইসা বলে চলেছে, “মিশব কী আর! মিশতেই তো চেয়েছিলাম। একটা দেশে
এসেছি। সেদেশের কতকিছু জানার ইচ্ছে ছিল। কোথাও একা একা যেতে পারি না। ইচ্ছেমতো
হাঁটাচলা, ঘোরাফেরা সবই বারণ। আমাদের দূতাবাস থেকে এখন ভীষণ সতর্ক করে দিয়েছে।
আমার এক বন্ধু, সেও আমার দেশেরই ছেলে, এই কিছুদিন আগে পুনেতে মারা গেল। আমি তখন ওখানেই
ছিলাম। একটা দুর্ঘটনা হয়েছিল ওর, রাস্তায়। কেউ কোনও সাহায্য করেনি। ব্যাঙ্গালোরে
কিছুদিন আগে রাস্তায় খুব বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েছে কয়েকজন। আর দিল্লির কথা তো
জান নিশ্চই”। আমি আর মাথা তুলতে পারছি না। ছি ছি! এ কী অবস্থা
করেছি আমরা! ‘অতিথি দেবো ভব?’ কিছু মানুষ, শুধু গায়ের রঙটা আমাদের চেয়ে কালো বলে এত অপমান? এত হেনস্থা? ছোট
ছোট ছেলে! বাড়িঘর ছেড়ে পড়াশোনা করতে এসেছে! কত কী দেখার, শেখার, জানার ছিল তো ভারত
থেকে! এরকম ঐতিহ্যশালী একটা দেশ! এতদিনের সভ্যতা-সংস্কৃতি! এত বৈচিত্র্য! এত
সমৃদ্ধি! “বাড়ি তো ফিরতে হবে! বাড়ি তো ফিরতে হবে!” আমার মাথার মধ্যে অবিরাম ঘুরে চলে কথাগুলো। আমি
মাথা নীচু করেই বলি “স্যরি ইসা, আমি সবার তরফ থেকে ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে। আমরা তোমাকে, তোমাদেরকে প্রাপ্য সম্মান দিতে
পারিনি। পড়াশোনা সেরে বাড়ি ফিরে যাও, সেফলি”। শুনে ও বলে, “ধুর তুমি কী করবে! আর আমি জানি সবাই একরকম না। অনেক ভাল লোকও
আছে। তবে আমাদের তো জীবন-মরণ সমস্যা! সেটাই মুশকিল”।
মনটা বিক্ষিপ্ত লাগছিল। জু-এর ভেতরেই একটা কাফেতে বসলাম দুজনে। বাইরে হালকা গরম। ইসা দুটো কোল্ড-ড্রিঙ্কস অর্ডার
দিল। পয়সা নিল না কিছুতেই। বলল,“আড়াই বছর এখানে আছি। কেউ কখনও ডেকে কথা বলেনি। নাম জিজ্ঞেস করেনি। জানতে চায়নি
কোন দেশ থেকে এসেছি। তোমায় পয়সা দিতে দেব না”। আমি বললাম,“কলকাতায় এস একবার। শুধু হায়দ্রাবাদ দিয়ে গোটা দেশটা বিচার কোরো না। এত বড় দেশ!
কতরকম মানুষ! কত ভাষা! তুমি যদি পাহাড়ে যাও কখনও, দেখবে গরীব গ্রামবাসীরাও তোমাকে
কী আদরযত্ন করছে। খুব সৎ আর সরল ওরা। আমার শহরেও অনেক আফ্রিকান আছে! নাইজেরিয়া
থেকে কত ছেলে ওখানে ক্লাবগুলোতে ফুটবল খেলে। তারা কিন্তু ভাল আছে। খবরের কাগজে
তাদের কত পার্টি, হৈ-হুল্লোড়ের ছবি দেখি। ইন্টারভিউ পড়ি। তুমি একবার যেও পারলে”। ইসা হাসে। বলে, “যাব দেখি। আসলে আমাদের এম্ব্যাসি থেকে বলেছে সাবধানে চলাফেরা করতে। এত
হ্যাঙ্গাম না! আমি এদেশে প্রথম এসেছিলাম তো বম্বেতে। তখন ভর্তি হওয়ার চাপে কিছু
দেখার সুযোগ পাইনি। তাই আর একবার গেছিলাম সেমিস্টারের পর। গিয়ে আর কোথাও বেরোতে পারলাম
না। এত অবসাদ জমেছে আমার! খুব খারাপ ছিলাম সেসময় আমরা সবাই। মনের মধ্যে সারাক্ষণ
দুশ্চিন্তা আর অকারণ ভয় থাকত। সেবারও হোটেলেই কেটে গেল দুটো দিন। কোথাও আর কিছু
দেখা হল না”। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা এদেশেই কেন এলে! আর এলে তো হঠাৎ এত জায়গা
থাকতে ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটি কেন?” ইসা বলল,“বললাম না, আমরা ইন্ডিয়ানদের পছন্দ করি? আমাদের দেশে এমনকি গোটা আফ্রিকাতেই
প্রচুর ইন্ডিয়ান! এদেশে আসার একটা বড় কারণ সেটা। আর আমার তো ইংলিশটা একেবারে জানা
ছিল না। আমার পড়াশোনা পুরোপুরি ফ্রেঞ্চে। আমরা ফরাসি উপনিবেশ ছিলাম তো। তাই জাতীয়
ভাষা এখনও ফরাসি। এছাড়া জানি অ্যারাবিক। সেটা আমার সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল। এই দুটো
ভাষাই ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটিতে চলে। আর আমি ইংলিশ একেবারে জানতাম না বলে বাবা
চেয়েছিলেন, এমন একটা কোনও দেশে থাকি, যেখানে ভাষাটা শিখতে পারব”। আমি অবাক হয়ে বলি, “তুমি মাত্র দু’-আড়াই বছরে বেশ ভাল ইংলিশ শিখেছ তো!” ও বলে, “হ্যাঁ, বম্বেতে নেমেছিলাম যখন ‘মাই নেম ইজ ইসা’ কথাটাও বলতে জানতাম না। আমার আসলে শিখতে খুব ভাল লাগে। যে কোনও কিছু। সময়
সুযোগ পেলেই শিখি। এখানে আমি বেছে বেছে কিনিয়ান, তানজানিয়ানদের সঙ্গে কথা বলতাম শুধু। যেহেতু ওরা
ইংলিশটা জানে”।
ইসা এখানে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। সঙ্গে ইলেক্ট্রনিক্স আর অঙ্ক। কেমন
লাগছে এখানে পড়াশোনা, ক্যাম্পাসের অবস্থা কেমন, জানতে চাইলে বলল,“এখানকার পড়াশোনা আমার মাথায় ঢুকছে না! আমাদের দেশে ছিল, যা
সিলেবাসে থাকবে, পড়ে পরীক্ষার সময় নিজের ভাষায় লিখতে হবে। তবেই এক্সামিনার বুঝবে
যে তুমি বিষয়টা বুঝেছ! এখানে ঠিক উল্টো। খুব মুখস্থ করতে হয়। একটা সায়েন্সের বিষয়ে
এক প্যারাগ্রাফ ভূমিকা লিখতে হয় আগে, যেটার কোনও দরকার নেই। আমার এগুলো একটু
অদ্ভুত লাগে”। আমি হাসলাম শুনে। বললাম, “ঠিক। কিন্তু এখন এই সিস্টেমেই তোমাকে মানিয়ে
নিতে হবে। একবার যখন মাথা রেখেছ হাড়িকাঠে। তবে আমাদের দেশের পড়াশোনা এখনও
অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে ভাল। তুমি যদি আমেরিকায় যাও দেখবে ছাত্ররা বাইরের কোনও
দেশ সম্পর্কে কিছুই জানে না। নিজের দেশটাও কতটা ভাল করে জানে সন্দেহ আছে। এখানে সারা বিশ্বের সবকিছু নিয়ে একটা ছোট্ট হলেও
ধারণা দেওয়া হয়। সেটা কারওর কাজে লাগে, কারওর লাগে না। কিন্তু এই জানবার অ্যাভিনিউ
খুলে দেওয়াটাও তো দারুণ। তাই না?” ইসা বলে,“হ্যাঁ তা ঠিক। আচ্ছা তুমি যে এই এতকিছু জান আফ্রিকা নিয়ে, সেও কি এইজন্যেই?” আমি বলি,“অনেকটাই। কলকাতায় গেলে তুমি দেখবে, আমি তোমায় যা
যা বলেছি তা অনেকেই জানে!” শুনে ও বলে,“বাঃ! কলকাতায় যেতে হবে তো! আর তোমার ইংলিশ উচ্চারণও ভাল দেখছি। এই ইংলিশ
কোত্থেকে শিখলে? এখানে তো আটাবাটাকাটা করে কী বলে কিছু বুঝি না!” আমি হাসতে হাসতে বলি,“সেটাও আঞ্চলিক কারণে। বললাম না, শুধু এই শহরটা
দেখে আমার গোটা দেশটা সম্পর্কে খারাপ ধারণা কোরো না। কলকাতায় এলে দেখবে সবাই আমার
মতো বা আমার থেকেও ভাল ইংলিশ বলে”। শুনে ও বলল,“তোমার থেকে বেশি ভাল কিছু কেউ করতে পারে না”। দুজনেই হাসলাম খুব। বললাম,“তুমি চিনুয়া আচেবে-র লেখা পড়েছ? বিখ্যাত নাইজেরিয়ান সাহিত্যিক যিনি? নাইজেরিয়ার বেশ কিছু এথনিক গ্রুপের অনেক কথা জেনেছি ওঁর বই
পড়ে”। ও মাথা নেড়ে ‘না’ বলে। “এনগুগি ওয়া থিয়ং? আমিনাত্তা ফোরনা? নুরুদ্দিন ফারহা? বেন ওকরি?” ও মাথা নেড়ে ‘না’ বলে। জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার এথনিসিটি কী? মাতৃভাষা কী?” ও বলল,“আমি জাঘাওয়া। আমার মাতৃভাষাও জাঘাওয়া। চাদ-এ আমাদের এই জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫% রয়েছে। আর বাকিরা আছে
দক্ষিণে সুদানে। চাদ-এ জাঘাওয়ারা কেউ তেমন এলেমদার কিছু না। আমাদের ভাষাটা তাই
ওখানে সেভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এক-দুইজন শিক্ষাবিদ আর পলিটিশিয়ান চেষ্টা
করেছিলেন। আমরা অত শিক্ষিত না তোমাদের মতো। দেখ আমি নিজের দেশের কোনও
লেখকেরই নাম বলতে পারছি না। আর তুমি বলে দিচ্ছ”। আমি বললাম, “না না। আসলে আমি দেশবিদেশের সাহিত্য পড়তে ভালবাসি তাই এঁদের নাম জানি। আর এঁরা
কেউই তোমার দেশের নন। নাইজেরিয়া, কিনিয়া, সিয়েরা লিওন এইসব দেশের। তবে সবই
আফ্রিকায় বলে জানতে চাইলাম। আমি বাঙালি। যদিও এটা আমার এথনিসিটি না। প্রদেশ বলা
যায়, ভৌগোলিক ভাবে। আমাদের ভাষা বাংলা। তুমি জান, পৃথিবীতে সবচেয়ে ব্যবহৃত ভাষার
বিচারে বাংলার স্থান সপ্তমে?” ও জিজ্ঞেস করে,“আমাকে বাংলা আর হিন্দী শেখাবে?” ওর শেখার আগ্রহ দেখে আনন্দ হয় খুব। আমি নিজেও
তো শিখতে খুব ভালবাসি। ওকে বলি, “শেখাব। যদি তুমি তার বদলে আমাকে ফরাসি শেখাও। ছোট থেকে আমার এই ভাষাটা শেখার
খুব ইচ্ছে”। ও বলে, “ডান! আমার একটা বই আছে। ফরাসি শেখার। তোমায় দেব”।
টেবিলে মুখোমুখি বসে আছি দুজনে। আমি ওর সারল্য আর
সততায় ভরা মুখটা দেখি। কী সুন্দর সেই মুখ! যেন ঈশ্বর তাকিয়ে আছেন হাসিমুখে। তাঁর মসৃণ কালো
চামড়ায় পিছলে যাচ্ছে রোদ। ইসা আমার হাতের দিকে তাকিয়ে
বলে,“আরে! তুমি দেখছি একটা সাপ-আংটি পরেছ! এটা রুপোর?” আমি বলি, “হ্যাঁ। আর এই
দেখ আমার কানে দুটো বেড়াল-দুল। আর এই ট্রাউজারে এত্তগুলো জেব্রা ছাপ। আজ
চিড়িয়াখানায় এসেছি বলে এরকম সাজ”। শুনে ও হাসে আর বলে, “তুমি কিন্তু
একটা পাগলি। আফ্রিকায় তুমি অবশ্যই যেও দোয়েল। আফ্রিকা তোমার মতো লোকদের খুব
ভালবাসে”। সেদিনকার মতো আড্ডা শেষ করে
আমরা বাড়ি ফেরার জন্য উঠে পড়লাম। যদিও দুজনেই জানি হয়তো আর দেখা হবে না। বেরনোর
আগে একসঙ্গে একটু ছবি তুলব ভেবে তাই এদিক সেদিক তাকিয়ে লোক খুঁজছি। দেখি দুটি
ছেলেমেয়ে সাইকেলে চেপে বেরোচ্ছে। হাসিমুখে আমাদের ছবি তুলে দিল তারা। একজন বিদেশি
লোক,
দেখে মনে হল
হয়তো আরবি হবেন, ইসাকে দেখে মাথা নেড়ে হাসলেন। আমার দিকে তাকালেনও না। পেছনে তাঁর
ফ্যামিলি। ইসাকে বললাম,“এটা কি ব্ল্যাক নড করল?” ও বলল,“কে জানে! হবে
হয়তো! এটুকু পাওয়াও এখানে অনেক!” গেটের বাইরে বেরিয়ে একটা ক্যাব ডেকে অপেক্ষা করছি।
ইসা আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। জনাকয়েক লোক হাসাহাসি করছে
আমাদের নিয়ে। কী ভাবছে কে জানে! বোধ হয় ভাবছে মেয়েটা ডেটিং-এর জন্য আর ছেলে পেল
না! বা হয়তো ভাবছে কেল্টেটার কী কপাল! একটা দেশি মেয়ে জুটিয়ে ফেলেছে। টোলিচৌকিতে
ওকে ড্রপ করে দিয়ে আমি বাড়ি ফিরে এলাম। খুব ক্লান্তি সারাদিনের। তাও মনটা কী খুশি
হয়ে আছে! একটা নতুন দেশের নতুন বন্ধু হওয়ার, নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়
হওয়ার আনন্দের সঙ্গে কোনওকিছুর তুলনা হয় না। এইজন্যেই তো বেড়াতে আসা। মানুষ চেনা, মানুষের
সঙ্গে মেলামেশা করা। মানুষকে বন্ধু করা, মানুষের বন্ধু হওয়া...
"I ain't lookin' to compete with you
Beat or cheat or mistreat you
Simplify you, classify you
Deny, defy or crucify you
All I really want to do
Is, baby, be friends with you.
No, I ain't lookin' to fight with you
No, I ain't lookin' to fight with you
Frighten you or tighten you
Drag you down or drain you down
Chain you down or bring you down
All I really want to do
Is, baby, be friends with you.”
![]() |
চিড়িয়াখানায় ইসার সঙ্গে |
আমার বাড়ির সবাই আর বন্ধুরা এর মধ্যে ডিটেইলস-এ জেনে গেছে ইসার কথা। ওকে নিয়ে
তাদের কাছে আমার বকরবকর আর থামছেই না। এরা আমায় বিলক্ষণ চেনে। এর আগে আমার
ইতালিয়ান বন্ধু ফ্রাঞ্চেস্কা, জাপানি বন্ধু নাবুয়াসো কিংবা ইরাকি বন্ধু জেওয়রকে
নিয়েও আমি এদের কানের পোকা নড়িয়েছি এভাবেই। কিন্তু মুশকিল হল যে বাড়িতে এসে উঠেছি
সেখানকার লোকজনকে নিয়ে। এদের ধরনটা ঠিক আমাদের মতো না। মেলামেশা, চিন্তাভাবনা, পড়াশোনার
যে মনোজগত, সেটা খুব সংকীর্ণ। দুটো কথা বলব সে উপায় নেই। সীমিত টপিক। এই অবস্থায়
ইসার কথা শুনে এদের তো মুখ শুকিয়ে যায়, চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। বলে,“নাইজেরিয়ানরা খুব ক্রিমিনাল হয় জানিস তো। দিনরাত
কাগজে বের হয় খুন করছে, ড্রাগ পাচার করছে”। তার আগে যদিও আমার অন্তত বার পাঁচেক বলা হয়ে গেছে এই ছেলেটি নাইজেরিয়ান না।
এবং বাকি সমস্ত কথাও।
আমার বর ফোনে আমার থেকে এবাড়ির পরিস্থিতি শুনে বলল, “বাড়িতে বেশি থেকো না। বাইরে বেরোও। শহরটা দেখ, শরীর বাঁচিয়ে যতটা পার। এবং পারলে ইসাকে সঙ্গে নিয়েই ঘুরে এস। তাহলে আমাদেরও চিন্তা
খানিকটা কম হয়। একদম একা থাকার চেয়ে একজন সঙ্গে থাকা ভাল। আর এবাড়িতে এতকিছু
জানানোর দরকার নেই। নিজে সাবধানে থাক। দিনের আলোয়, একটা ব্যস্ত শহরে, এত লোকের মাঝে ভয়ের কিছু তো নেই! তুমি তো একা একা কত
জায়গা ঘুরেছ!” ইসাকে বললাম সেকথা। ইতিমধ্যে ওরা দুজন ফেসবুকে আর ফোনে আলাপপর্ব সেরে নিয়েছে! ইসা বলল, “তাহলে মিউজিয়ম যাব। আমার খুব ভাল লাগে মিউজিয়মে ঘুরতে”। আমি বললাম “সেই ভাল। আমারও দেখা বাকি। আগেরবার অস্ত্রাগারটা খুব ভাল করে দেখেছিলাম। এবারে তাহলে সব পেইন্টিংগুলো দেখব”।
চার মিনার –হুসেন সাগর
ইসা আমাকে একটা ভদ্র দোকানের
ভেতরদিকে বসিয়ে দিয়ে চারমিনারের ঠিক পাশেই মক্কা মসজিদে নমাজ পড়তে গেল। আমি বসে
বসে অনেক বেছে, ভেবে একটা স্পেশাল লস্যি অর্ডার করলাম। এই জায়গাটা ফ্যামিলির
জন্যে। তাই চারপাশে কোনও বখাটে ছোকরা নেই। একটা দুটো পরিবার এল একে একে। এবং তারা আমাকে ওই পরিবেশে
খানিক কিম্ভুত ঠাওরাল। দোকানের ছেলেটা এসে ঠকাস করে একটা বড় গ্লাস লস্যি দিয়ে গেল।
তাতে লাল-গোলাপি সিরাপ দেওয়া। ওপরে কাজু কিসমিস ঠাসানো। দু’চুমুক দিয়েই বুঝলাম এই ভয়ংকর ঘন আর কিরকিরে মিষ্টি শরবতটা
গলা দিয়ে নামানো কঠিন। এদিকে সময়ও তো কাটাতে হবে। বাইরে বীভৎস রোদ আর গরম। আমার
আশপাশের লোকজন দিব্যি হাত লাগিয়ে চিকেন আর মটন বিরিয়ানি, তন্দুরি রোটি, ফিরনি এসব
সাঁটাচ্ছে এবং আড়চোখে আমাকে দেখছে। আমি নির্বিকার মুখে ফোন হাতে খুটুর খুটুর করে চলেছি এবং
পাঁচ মিনিটে একবার করে সেই ‘শরবত-এ-দোজখ’-এ চুমুক দিচ্ছি। বা বলা ভাল কামড় বসাচ্ছি।
“শরবত-এ-দীদ পিলা দো আকা
জাম –এ-কওসর কে পিলানেওয়ালে”
দুজনে হিহিহাহা করতে করতে একটা অটো ধরে ফেললাম। তারপর কাফে বাহারে বসে ফিশ
বিরিয়ানি আর খুবানি কা মিঠা খেয়ে মন তর হয়ে গেল। আহা রে! কী ভাল বিরিয়ানি। ভাবলাম
বাড়ির জন্যেও নিয়ে যাই এক প্যাকেট। রেস্তরাঁটায় একজন বাঙালি ম্যানেজারও আছে। তাকে
বললাম, “দাদা একটা বিরিয়ানি বাড়ি
নিয়ে যাব। প্যাক করে দিন”। সে বললে,”ম্যাডাম এখানে শুধুমুধু ট্যাক্স বেশি পড়বে। নিচেই আমাদের
টেক-অ্যাওয়ে থেকে নিয়ে নিন”। নিচে গিয়ে বিরিয়ানি প্যাক
করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম, “হুসেন সাগর এখান থেকে
কদ্দুর?” শুনে ডেস্কের ওপাশের বয়স্ক
ভদ্রলোকটি বললেন, “কাছেই। মিনিট দশ লাগবে”। আমিও গুগল ম্যাপে সেরকমই দেখেছি। আবার আর একটা অটো ধরে চলে
গেলাম হুসেন সাগর।
বিরাট বড় একটা লেক। বিখ্যাত
চিত্রশিল্পী হিরণ মিত্র, আমাদের কলকাতার হিরণদা, আমি এখানে আসব শুনে এই লেকের মাঝে যে বুদ্ধমূর্তিটি
আছে... সেটি বসানো নিয়ে নানান মজার গল্প বলেছিলেন। তার মধ্যে একটি হল, মুর্তিটি
বসানোর সময় নাকি জলে পড়ে ডুবে গিয়েছিল। তারপর ক্রেনে করে সেটিকে তুলে, ফের নতুন
করে নানান হিসেব কষে, শেষমেশ বসানো যায়। তার জন্য ছোট ছোট ইঞ্জিনিয়ারিং নক্সা আর
মডেল তৈরি করতে হয়েছিল। এবং ওঁর এক নিকটাত্মীয় সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তিনিও
সঙ্গে ছিলেন। মূর্তির গা বেয়ে বাঁশের ম্যারাপ বাঁধা হয়েছিল। তিনি সেই বাঁশের ভাড়া
বেয়ে উঠেও ছিলেন।
ইসা আর আমি টিকিট কেটে সঙ্গের বিরিয়ানির প্যাকেট জমা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সবাই
ধরেই নিয়েছে আমরা প্রেম করছি। নাহলে খামোখা দুটো ছেলেমেয়ে ভরদুপুরে লেকের ধারে
বসতে আসবে কেন! পার্ক পরিস্কার রাখেন যে আম্মারা, তাঁরা ইসাকে দেখে মুখ টিপে
হাসছেন। একটা ছাইরঙা বেড়াল আমাদের বেঞ্চের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। সেটারও গায়ের রঙ
ইসার চেয়ে ফর্সা। সবাই ফর্সা হওয়ার আনন্দে ভাসছে। সামনে লেকের জলে আলতো করে দুলে
চলেছে কয়েকটা নোঙর করা লঞ্চ। রোদ এসে জলের মাঝখানে তীব্র সোনালি রঙের একটা রাঙতা
ফেলে দিয়েছে। সেদিকে তাকানো যাচ্ছে না। চোখ ঝলসে যাচ্ছে। অনেক দূরে ভেসে যাচ্ছে
কিছু নৌকো, ট্যুরিস্টসমেত। আমরা পাড়ের যেদিকটায় একটু ছায়া, সেদিকে বসেছি। একটা
বিরাট বটগাছ ঝুরি ফেলে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে। তার পায়ের কাছে ছলাৎছল করছে ঢেউ।
![]() |
একটা বিরাট বটগাছ ঝুরি ফেলে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে। তার পায়ের কাছে ছলাৎ ছল করছে ঢেউ। |
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইসা
আমাকে বলে,“তোমার ছেলেমেয়ে আছে?” আমি বলি,“না। তেমন কোনও ইচ্ছেও নেই”। শুনে ও বলে,“কেন?” আমি বলি,“কী হবে বল! কী দিয়ে যেতে পারব তাকে? একটা সুস্থ সুন্দর পৃথিবী? পরিস্কার
বাতাস? টাটকা সব্জি? খেতের ফসল? নদীর মাছ? সবেতে তো বিষ! তার ওপর এই এত এত লোক!
গিজিগিজ করছে চারপাশে। খাচ্ছেদাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, বাচ্চা পয়দা করছে, মরছে, মারছে!
আগে ভাবতাম ভুল জায়গায় জন্মেছি। এখন বুঝি ভুল জায়গা বলে কিছু হয় না। আর যতদিন
যাচ্ছে ভুল জায়গার ভূগোল সমানেই কমে আসতে থাকছে। এত রক্ত-হিংসা-অসুখ! এর মধ্যে আর
ভিড় বাড়ানো কেন!” শুনে ও খানিক থমকে যায়। বলে,“না দোয়েল! এভাবে বোলো না। জানি এগুলো সবই সত্যি। তবু তোমার সন্তান তো তোমার
মতোই ভাল হবে। তোমার মতো মানুষের এখন খুব দরকার পৃথিবীতে”। আমি শুনে হাসি। হেসে বলি,“তুমি আমাকে চেন নাকি! আমি ভাল এত বিশ্বাস আসছে কোত্থেকে?” ও বলে,“আমি জানি। এটুকু বোঝা যায়”। আমি বলি,“তোমার বাড়ির কথা বল বরং! কে কে আছেন। তুমি বিয়ে করেছ?” ও বলে,“না! আমাদের দেশে এখনও পলিগ্যামি নিষিদ্ধ না। ইচ্ছে করলেই
একজন পুরুষ চারটে বিয়ে করতে পারে। আমার এটা ভাল লাগে না। আমি কখনও একটার বেশি বিয়ে
করব না”। আমি বলি,“বাঃ! খুব ভাল সিদ্ধান্ত। তোমার গার্লফ্রেন্ড
আছে?” ও বলে,“নাঃ! ছিল। কিন্তু তার বিয়ে হয়ে গেছে। ভাল মেয়ে। এক স্কুলে পড়তাম আমরা। আমার
চেয়ে এক ক্লাস ছোট ছিল ও। কিন্তু ওর বাবা জেনে ফেললেন। তারপর জোর করে বিয়ে দিয়ে
দিলেন ওর”। আমি বললাম,“তুমি কিছু করলে না? পালিয়ে গেলে না কেন!” বলল,“আমাদের ওখানে এই ব্যাপারগুলো তোমাদের মতো না গো! ধরা পড়ে
গেলে ওর বাবা ওকে মেরে ফেলতে পারতেন। ওর বেঁচে থাকাটা আমাদের একসঙ্গে থাকার চেয়ে অনেক বেশি দামি”। খুব মন খারাপ হয়ে গেল। বললাম,“আমাদের এখানেও এরকম আছে। এদেশেও। ‘অনার কিলিং’ বলে একে”। ইসা বলল,“তার ওপর আমি বাড়ির বড় ছেলে। আমার পরে আরও দুই
ভাই আর এক বোন। আমাকে তো পায়ে দাঁড়াতে হবে। পালিয়ে যাব কোথায়! আমি যখন খুব ছোট, আট
মাস বয়স, তখন আমার নিজের বাবা মারা যান। আমাদের নিয়ম অনুযায়ী আমার কাকা আমার মাকে
বিয়ে করেন। কাকাকেই আমি বাবা বলেছি চিরকাল। তিনি আমাকে নিজের ছেলেমেয়ের মতোই
ভালবাসেন। আমার কোনও কিছুর অভাব রাখেন না। তিনিই তো পয়সা খরচ করে আমাকে পড়তে
পাঠিয়েছেন”। আমি বলি,“বাঃ! খুব ভাল লাগল শুনে। এমন ভালবাসা পাওয়া তো
ভাগ্যের ব্যাপার”। ইসা বলে,“আসলে আমাদের দেশ এখন পলিটিকালি একটু স্থিতিশীল
হয়েছে। কিন্তু একসময় এরকম ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই চাদ-এ পরপর নানান
রাজনৈতিক পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল। প্রথমে ফরাসিদের হাত থেকে স্বাধীনতা, তারপর
মিলিটারি শাসন, তারপর সিভিল ওয়র। এই শেষ গৃহযুদ্ধের সময়টায় মানে ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ এই
আট বছরের মধ্যের সময়টায় আমাদের একজন স্বৈরতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট ছিলেন। হেইসেন হাবরে।
তাঁর আমলে চাদ-এর সঙ্গে উত্তরে প্রতিবেশী দেশ লিবিয়ার প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এবং তিনি
প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষকে বন্দী করেন ও হত্যা করেন। আমার বাবাও এরকমই একজন বন্দী
ছিলেন। রাজনৈতিক বন্দী। এবং জেলেই তাঁর মৃত্যু হয়। ইদ্রিস দিবি এসে হাবরেকে ক্ষমতা
থেকে সরানোর পর চাদ-এ শান্তি ফিরে আসে। উনিও আমাদের মতোই একজন জাঘাওয়া। যদিও পরেও
আবার গৃহযুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এখন সুদান থেকে, নিগের থেকে অনেক মানুষ এসে নিজেদের
দেশের অশান্তির কারণে আমার দেশে আশ্রয় নিয়েছে। খুব গরীব আমার দেশ
দোয়েল। তুমি যে লেক চাদের কথা বলেছিলে
প্রথম দিন, সেই লেক চাদ কবেই শুকিয়ে গিয়েছে! একটু বৃষ্টি হয়
না। চাষের জমি খুব কম। উট চরিয়ে খায় লোকে। দক্ষিণ দিকটায় যা একটু সবুজ আছে।
সেখানেই গোটা দেশের মানুষ ভিড় করেছে এসে। আমরাও সবাই ন্-জামিনায় থাকি।
আমাদের দেশের ক্যাপিটাল। ইন্ডিয়া থেকে পড়াশোনা শিখে দেশে ফিরে কিছু করতে
চাই”।
কতক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম দুজনে। আমি বললাম,“ইসা জান, কথার কথা নয়, আফ্রিকা নিয়ে সত্যিই আমার
খুব ভাল লাগা আছে একটা। আমরা সবাই তো অনেক অনেক লক্ষ বছর আগে একসময় আফ্রিকাতেই
ছিলাম। আমাদের সবার পূর্বপুরুষ। তারপর সেখান থেকেই বাকি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছি। তাই
আফ্রিকা শুনলেই মনে হয় যেন খুব অতীতের একটা কানেকশন আছে। একটা শিকড়। আফ্রিকান
মানুষজন আমার ভাল লাগে। আফ্রিকার কত ছবি আমি দেখেছি দিনের পর দিন বসে বসে। মাসাই,
পিগমি, সান, তুতসি, জুলু, হুতু, সামবুরু এদের ছবি। এদের বাড়িঘর, গয়নাগাটি, উৎসব...!
আবদেরহামান সিসাকো আফ্রিকার একজন বিখ্যাত ফিল্ম ডিরেক্টর তুমি জান নিশ্চই। তাঁর
বেশ কিছু সিনেমা আমি দেখেছি। তারপর তোমার দেশেরই মাহামাত সালেহ হারুন। তাঁর
সিনেমাও। আমার খুব ইচ্ছে একদিন আফ্রিকা যাওয়ার। একবার কিনিয়াতে একটা জুলজিকাল
প্রোজেক্টে অ্যাপ্লাই করব বলেও ভেবেছিলাম। জেব্রা সেনসাস নিয়ে ছিল কাজটা। কিন্তু নানান অসুবিধেয় সেটা আর বাস্তবায়িত করতে পারিনি। তোমার মধ্যে দিয়ে আমি একটু আফ্রিকা ছুঁতে
পারলাম যেন”। ইসা বলে,“আর তোমার মধ্যে দিয়ে একটু ইন্ডিয়া। এই ইন্ডিয়াটাই
মনের মধ্যে কল্পনা করে এসেছিলাম এখানে”। আমার চোখে জল এসে যায়। কোনও কথা না বলে চুপ করে
বসে থাকি দুজনে। কতক্ষণ! বিকেলের আলো এসে ঝিমিয়ে পড়ে লেকে। তারপর একসময় উঠে বাড়ির
মুখে রওনা দিই।
ট্যাক্সিতে ড্রপ করে দেওয়ার আগে ইসাকে বলি, “ভাল থাকিস ইসা। আবার নিশ্চই দেখা হবে। কলকাতায়”। ইসার মুখ ভার হয়ে আসে। হেসে বলে,“যাব। তোমার বাড়িতে নিশ্চই যাব আমি”। তারপর বলে,“এই যাঃ! সারাদিন বয়ে বেড়ালাম অথচ ভুলেই
যাচ্ছিলাম আরটু হলেই। এই যে ফ্রেঞ্চ শেখার বই। নিয়ে এসেছিলাম”। একটা বহুপঠিত প্রায় দুভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া বই আমার হাতে গুঁজে দেয় ইসা। আমি বলি,“ম্যেরসি বুখু!” ও একগাল হেসে বলে,“এঃ! ফরাসিও জান তুমি!” আমি বলি,“কচু জানি বোকা!” ও বলে,“এই বোকা মানেটা কি!” আমি ব্যাখ্যা করি। ও খুব হাসে। আমি বলি,“তোমার নামের মানে আমাকে বললে না তো?” ও বলে,“ইসা মানে তো যীশু। মানে আমাদের প্রফেট। আর বাদবাকি নামগুলো
আমার পূর্বপুরুষের। সালেহ আমার বাবা, ইসা আমার ঠাকুর্দা আর দাউকারদা হলেন ঠাকুর্রদারও
বাবা। আমাদের এখানে এভাবেই সবার নাম হয়। তোমার?” আমি বললাম,“আমার নাম নিয়ে এত অল্পে হবে না। একদিন সারাদিন
বসে বলতে হবে। অনেক অনেক গল্প! আমায় তোমার ডাকনাম বল দেখি?” ও বলে,“ছোটবেলায় আমার দাঁতগুলো ছিল কালো কালো। তাই আমার নাম হল
মার্কি কোন্দো। মার্কি মানে কালো আর কোন্দো মানে দাঁত”। শুনে আমাদের ট্যাক্সির ড্রাইভারও প্রায় হেসে গড়ায়। ইসা বলে,“আর তোমার ডাকনাম?” আমি বলি,“নেই”। ও খুব দুঃখ পায় শুনে, বলে “এঃ! আমিই তাহলে একটা নাম দিই। তোমায় আমি বরং
ডাকব তিঙ্গি বলে!” আমার তো চমৎকার লাগে শুনে। বলি,“কী সুন্দর শুনতে! এর মানে কি?” ইসা বলে, “বিউটিফুল গার্ল। বিউটিফুল অ্যান্ড পিওর”। আমি হাসতে থাকি। টোলিচৌকি এসে গেল তার পরে পরেই। ইসা নেমে গেল। আমি অফিসটাইমের
জ্যামে আটকেও সারাটা রাস্তা একটা ঘোরের মধ্যে বসে রইলাম। এমন সুন্দর দিন খুব কম
আসে। আসলে সময় যে কিছুই না... বারবার প্রমাণ হয় সেটা। সম্পর্ক...যার সঙ্গে হওয়ার,
এক মুহূর্তেই হয়। আর না হলে জন্মজন্মান্তরেও হওয়ার নয়।
![]() |
মার্কি কোন্দো |
বাড়িতে ফোন করলাম। বাবা মার সঙ্গে কথা বলে, ওঁদের গলা শুনে মন ভাল হল। ইসাকে
বললাম,“কলকাতায় এলে দেখা হবে ফের”। ইসা বলল,“আমার ভাই ইসাখা, যার সঙ্গে আমি এখানে রুম শেয়ার
করে থাকি আর দুই বন্ধু তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। তুমি কি আর একটা দিন আধ ঘন্টার
জন্য হলেও একবার দেখা করতে পারবে? তোমার বাড়ির কাছাকাছি কোথাও? কারণ তুমি যেখানে
আছ আমি সে বাড়ি যেতে চাই না। আমার জন্য আনসেফ হতে পারে”। আমি বললাম,“হ্যাঁ! ওরাও তোমাকে আনসেফ ভাবে! তুমি একে ব্ল্যাক, তায় মুসলমান। অথচ কাজের
সূত্রে এদের অনেক শ্বেতাঙ্গ লোকের সঙ্গে আলাপ আছে। তাদের নিয়ে কত গল্পই না করে! দেখি
যদি পারি, তাহলে একবার ঘন্টাখানেকের জন্য হলেও শেষবার দেখা করে নেব। এবাড়ির পাশেই
একটা কাফে আছে। আমার হার্ড-ডিস্কটা নিয়ে যেতে পারি। তুমি যদি ল্যাপটপ নিয়ে আস
তাহলে সব আফ্রিকান আর অন্য যা যা সিনেমা তোমার দেখতে ইচ্ছে করে বলছিলে, সব কপি করে
নিতে পারবে”। ইসা বলল,“সেই ভাল!”। বলল,“তুমি কি আবারও ওদের না জানিয়ে আসবে নাকি?” আমি বললাম,“নাঃ! কোনও অন্যায় তো করছি না। মিথ্যা বললে অপমান হচ্ছে নিজেরই!” ইসা জিজ্ঞেস করে,"আচ্ছা এরাও কি তোমার মতো বাঙালি?" আমি বলি,"হ্যাঁ! কী করা যাবে বল। সবাই তো একরকম হয় না। দেখছ তো আমার বরকে সব কথা বলতে পারছি। সে বলছে তোমার সঙ্গে বেরোতে। আর এদের অবস্থা! যে যেভাবে জীবনকে দেখে!" ইসা হাসে। আমিও।
খুদা হাফিজ
খুদা হাফিজ
দেখা করেছিলাম ঠিক চলে আসবার দিন
সন্ধেয়। ইসা সব সিনেমা কপি করে নিয়েছিল। আর প্রচুর প্রচুর আড্ডা দিয়েছিলাম আমরা
আবারও। মাঝে ওর এক সুদানিজ বন্ধু এসেছিল আর ওর রুমমেট ইসাখা, যে ওর কাজিন ভাই। কী
মিষ্টি ছেলেগুলো। সবাই এসে আমাকে গ্রিট করে গেল। বলল,“তোমার মতো ইন্ডিয়ান কমই দেখি আমরা। কখনও আফ্রিকা
গেলে আমাদের বাড়ি যাবে। সেখানেই থাকবে। আমরা ঘুরিয়ে দেখাব তোমাকে”। আমি বললাম,“হ্যাঁ তো! সেই লোভেই তো এত খাতির করছি তোমাদের!” হো হো করে হাসল সবাই। কাফে থেকে বেরিয়ে ‘করাচি বেকারি’ গেলাম ইসার সঙ্গে। কলকাতার বন্ধুদের জন্য কিছু
কুকিজ নিলাম। মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিলাম ইসার। ইসা আমার থেকে জেনে নিয়ে
মাকে পরিস্কার বাংলায় বলল,“নমস্কার মা!” মা ওকে বারবার আসার কথা বললেন। ইসা ফোন রেখে আমায় বলল,“তুমি কেন এরকম বুঝেছি। তোমার মা আসলে খুব ভাল।
আমাকে উনি চারবার ‘প্লিজ’ বললেন। বললেন ‘প্লিজ আমাদের বাড়ি এস। এদেশ থেকে মন খারাপ নিয়ে ফিরে যেও না। এখানে থাকবে। আমি
রান্না করে তোমাকে খাওয়াব। তুমি তো আমার ছেলেরই মতো’ ”। আমি বললাম,“তবে?”
কলকাতা ফেরার প্লেন ভোরবেলায়। এয়ারপোর্ট থেকে
মেসেজ করলাম ইসাকে। লিখলাম,“এরপর আবার কখনও হায়দ্রাবাদ এলে খুব মন খারাপ হবে ইসা। তুমি ততোদিনে হয়তো
পড়াশোনা করে দেশে ফিরে যাবে”। উত্তর এল না। মনে হল ঘুমন্ত ইসার মুখটা দেখতে
পেলাম। ছেলেমানুষ। ঘুমাক। একটু শান্তিতে থাকুক। প্লেন মাঝ-আকাশে উড়ান নিয়েছে যখন, ঘুম-ঘুম
পাচ্ছে আমার। কানে ইয়ারফোন গুঁজে একটু এলিয়ে শুলাম। আমার পাশের সিটে কেউ নেই। হাত পা ছড়িয়ে বসতে
পারছি। কোলে ব্যাগ রাখতে হচ্ছে না। বাইরে পুঞ্জীভূত মেঘের স্তম্ভ! সকালের প্রথম
আলো পড়ে তাতে ছিটকে পড়ছে সাত রঙ! নীল থেকে গাঢ়, ঘন নীল হচ্ছে আকাশ, ক্রমে...আমার
আইপডে একটি শিশুকন্ঠে বাজছে,“মওলায়া সল্লি বা ওয়াসল্লিমদা ইমান আবাদন...আলা হাবি বিকা খাইরিল খলোকি কুল্লি
হিমি”! কী সুন্দর এই পৃথিবী! কী সুন্দর এই মানুষজন্ম! খুদা, ঈশ্বর...তোমার করুণা,
তোমার স্নেহাশিস সদাই আনন্দ হয়ে ঝরে পড়ুক আমার প্রাণে!
“হাবিবুল্লাহ! রসুলুল্লাহ! ইমাম-আল মুরসলীন!
আল্লাহুম্মা সল্লি আলা
সয়িদিনা মুহাম্মাদিন
ওয়া আলা আলি
সয়িদিনা মুহাম্মাদিন
ওয়াবারিক ওয়া সল্লিম”।
দুহাতে মুখ ধুয়ে নিচ্ছি যেন আমি... আমার ভেতরটা ভরে উঠছে শান্তিতে... বাইরে
তখন আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর।
বাড়ি ফিরছি।
দোয়েলপাখি দাশগুপ্ত
১৯৯৬
visan sundar lekha...mon chuye gelo....
ReplyDeleteThank you :)
Deleteএই লেখাটা পড়তে পড়তে এই গানটা শোন :D :)
ReplyDeletehttps://www.youtube.com/watch?v=kqwKFZ6cD3M
Khub sundor laglo r ektu montao kharap hoye gelo eibhebe jodi tokhon thaktum tobe amar o porichoy hoye jeto..
ReplyDeleteMelaben tini melaben. Ke bolte pare Rituparna? :) Hoyto emon i sundor kono Issa-r songe ekdin tor o alap hobe. Takhon amar tor songeo to alap chilo na. Ebar Kolkatay ele dekha koris. Ar ami Hyderabad abar jodi jaai aboshyoi meet korbo. Issa somet :D
DeleteObosoyoi meet korbo..
DeleteDarun laglo Doel....amazing. sottyi tor moto erom jibon bodh amader sobar nei. Eromi thakish.
ReplyDeleteThank you Chandrikadi.. urf Unknown! :D hee hee hee
Deletejeebon bodh asole achhe tomader o ... na hole eta appreciate korte parte ki? :) Love you.
Darun laglo Doel....amazing. sottyi tor moto erom jibon bodh amader sobar nei. Eromi thakish.
ReplyDeleteএই লেখাটা এই নিয়ে তিনবার টানা পড়লাম। এমন লেখা পড়লে মনে হয় যেন স্নান করে উঠলাম।
ReplyDeleteমন ভরে গেল
ReplyDeletePorasona-r sutre bochhor duek Hyderabad e thakte hoechilo. Issa r pashapashi shohor tar bornona-o onek smriti mone korie dilo. :)
ReplyDelete21 bochor aage lekha ? ki r boli? tomar subject ki chilo? zoology na geology? proshnotar 1ta karon ache eisob lekha niye 1ta pathjoggyo boi hote pare! valo theko ... biswajit
ReplyDeletena gato bochhor lekha!! :O
ReplyDelete