জ্যে সুই পারি



এ গল্প সেই সময়ের যখন প্যারিসের সাথে গোটা দুনিয়া সেভাবে আত্মীয়তা বোধ করেনি ফেসবুকের মাধ্যমে। 

পর্তুগালের 'টক' শেষে আমি তখন প্যারিসগামী, ল'রিয়েলের অফিসে এক হাই ভোল্টেজ মিটিং–এ যোগ দিতে। সাধারণত নেদারল্যান্ডস থেকে যখন প্যারিস যাই কাজের সূত্রে, বসের গাড়ি করেই যাই। এবার তার অন্যথা হল। সময়ের কথা মাথায় রেখে, পর্তুগাল থেকে সোজা প্যারিস গেলে আরও দুটো দিন পর্তুগালে কাটাতে পারি, এই লোভে। সুরিন্দর, আমার স্বামীও এসেছিল সঙ্গে। সে নেদারল্যান্ডস ফিরে গেল, যেদিন আমি প্যারিস-মুখো। রওনা দেওয়ার আগের রাতে ইন্টারনেটে রুট-প্ল্যানটা দেখে বুঝেছিলাম, যে বিমানবন্দরে আমি নামব সেখান থেকে আমার হোটেল প্রায় চার-পাঁচ ঘন্টার পথ। ঠিক হল, “লা ক্যুঅনভ 8 May 1945” মেট্রো স্টেশনে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছব গন্তব্যস্থলে।

একটা মাঝারি মাপের বেশ ভারী সুটকেস নিয়ে শেষমেশ যখন লা ক্যুঅনভ-এ নামলাম, তখন আমি ক্লান্ত, অবসন্ন ও ক্ষুধার্ত। তার সঙ্গে গোটা ফরাসি জাতটার ওপর তিতিবিরক্ত। প্যারিস ওরলি বিমানবন্দরে ইতস্ততঃ ছোটাছুটি দিয়ে আমার আজকের হেনস্থার শুরু। বিমানবন্দরে অ্যাডভেঞ্চার গ্রাউন্ড ক্রুরা ইংরাজি বলতে অস্বীকার করায়, সদ্য সারানো একটা সেকশনের ঠিক কোন এক্সিট দিয়ে বেরোলে বাসের সন্ধান পাওয়া যাবে বুঝতে গিয়ে আমি তখন গলদঘর্ম। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ছুটোছুটির পর ইংরাজি বলায় অনিচ্ছুক ফরাসিদের দেওয়া নির্দেশাবলীর বোধগম্য সিকিভাগ এবং নিজের সহজাত বুদ্ধির পঁচাত্তর ভাগ সাথে নিয়ে বেরোলাম বাস ধরতে। বাইরে তখন প্রকৃতিদেবীও বাম। চলছে মুষলধারে বৃষ্টি। বাসে ওঠার প্রায় তিরিশ মিনিট পর পৌঁছলাম ট্রাম স্টেশন। সেখান থেকে ট্রামে করে মেট্রো স্টেশন। নিজের প্রস্তুতির জন্যে নিজেরই পিঠ চাপড়াচ্ছি তখন। রোমে গিয়ে রোমান হওয়ার গর্বে গর্বিত আমি কেমন প্যারিসের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছি স্থানীয় পরিবহনে। এই না হলে 'ইন্ডিপেন্ডেন্ট উওম্যান'!

যাক গে, প্রায় পনের কুড়িটা মেট্রো স্টেশন পার করে এল সেই কাঙ্ক্ষিত লা ক্যুঅনভ। এর এক বছর আগেই আমি মা-বাবাকে নিয়ে প্যারিস চষে ফেলেছিলাম। এই স্টেশন তাই আমার অজানা নয়। আর প্যারিসে আসা মানে তো ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে পথ চলা। হোটেল দা ভিল-এর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আবার একবার মনে মনে তারিফ করতে করতে চলেছি প্যারিসের মাটির নীচ দিয়ে। বেশ জানি আর কিছুক্ষণ পরেই ট্যাক্সিতে গা এলিয়ে হোটেলে পৌঁছব। তারপর হট শাওয়ার, রাতের খাবারের অর্ডার, আইপ্যাডে একটু এদিক সেদিক। এরই মধ্যে আশা করি আমার বস পৌঁছে যাবেন। তাঁর সাথে একটু গল্পসল্প করে, টক কেমন হল জানিয়ে, শেষবারের মতো একবার প্রেজেন্টশন খুলে একটু চোখ বুলিয়ে আজকের এই লম্বা, হাক্লান্ত দিনটার অবসান হবে। কাল আবার সকাল নটার মধ্যে লরিয়ালের অফিসে হাজিরা। 

লা ক্যুঅনভ-এ নেমে বাইরে এসে দেখি তখনও সূর্যদেব প্রসন্ন। ঘড়ির কাঁটা সাতটা দেখালেও এখন ইউরোপের গ্রীষ্মকাল। তাই এমনটাই স্বাভাবিক। আসলে অতক্ষণ মাটির নীচে থেকে আমারই ভ্রম হচ্ছিল। ব্যাগটাকে টেনে সিঁড়ি দিয়ে তুলে একটু হাঁফাচ্ছিলাম। সেটা থামতেই মনে হল “না জানি কোথা এলুম!” এটা কি মানে ইয়ে প্যারিসই তো?! দেখে তো মনে হচ্ছে এটা ঘানাও হতে পারে, আবার মালয়েশিয়াও হতে পারে। চারিদিকে আধুনিক ওয়েস্টার্ন পোশাকের একজনও প্রায় চোখে পড়ল না। প্যারিসে এমন শহরতলি আমার অপরিচিত নয়। তবে লা ক্যুঅনভ-এর বাইরেটা এমন হবে, ভাবিনি ঠিক! কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এদিক ওদিক ঘাড় ঘুড়িয়েও যখন কোন ট্যাক্সি স্ট্যান্ড চোখে পড়ল না, তখন সামনে ল্যাম্প পোস্টে হেলান দেওয়া আমারই মতো দেখতে(পড়ুন এশিয়ান) এক ছোকরাকে জিগ্যেস করলাম, “দাদা ট্যাক্সি কোথায় পাব?” সে দুই সেকেন্ড মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর আবার নিজের মোবাইল ফোনে মুখ গুঁজে বললো, “ট্যাক্সি তো এখানে পাওয়া যায় না!”

আমিঃ (মনে মনে)আহা! কী রসিকতা! 

(জোরে জোরে) “মানে? ট্যাক্সি পাওয়া যায় না মানে?”

সেঃ “এটা খুব গরীব এলাকা। এখানে ট্যাক্সি চড়বার সামর্থ্য কারওর নেই”।

জলপ্রপাত, জলোচ্ছ্বাস, অগ্ন্যুৎপাত !!!

কিন্তু আমি আমার নিরাপত্তাহীনতা দেখাই কী করে! একে তো আমি চিনিই না। আমার নিবে যাওয়া মুখ দেখে ছেলেটির হয়তো বা দয়া হল। বলল,“কোথায় যাবেন?" নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে আমি ব্যাগ থেকে গুগল ম্যাপের প্রিন্ট-আউটটা খচর মচর করে বের করে দেখালাম। সে দেখে, তার ফোনে কী সব টিপে টিপে বলল, না সে এ জায়গা চেনে না। হোটেল তো নয়ই। স্থানীয় যানবাহনের পরিষেবা আছে কিনা সে প্রশ্নে কী একটা বিড়বিড় করতে করতে সে এবার একটা ইংরাজি, তারপর আবার ফরাসি, আবার ইংরাজিতে কার সাথে একটা কথা বলে, ফোনটা আমায় দিয়ে বলল কথা বলতে। অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন শুনে বুঝলাম কোনও এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ফোন করেছে। আমার ফোনে রোমিং না থাকায় নিজের ফোন থেকেই করেছে। প্রায় পাঁচ মিনিট আমি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বুঝিয়েসুজিয়ে লা ক্যুঅমভ-এ নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালালাম। সে ফরাসিতে অনেককিছু বলে ফোন কেটে দিল। বুঝলাম এই স্টেশনের নাম তার কাছে পরিচিত নয়।

আমার চোখেমুখে, শরীরী ভাষায় এবার অজ্ঞান হওয়ার পূর্বাভাস। সুরিন্দর তখনও মাঝ-আকাশে, আমার বস গাড়ি চালাচ্ছেন। তাঁর মোবাইল ফোন নেই। আমি লরিয়াল, প্যারিসের কারুর নম্বরে ফোনও করতে পারব না। কারণ আমার রোমিং নেই।

অবস্থা বেগতিক দেখে ছেলেটি আবার একটা নম্বরে ফোন করে কথা বলে আমায় জানাল যে সে তার এক বন্ধু, যে নাকি এ দিকটা আরও ভালো চেনে, তাকে আসতে বলেছে। বন্ধুটি যতক্ষণে এসে পৌঁছল, ততক্ষণে আমি জেনে গিয়েছি এই ছেলেটি পাকিস্তানি। তার বন্ধুটিও তাই। প্যারিসে প্রায় সাত-আট বছর ধরে আছে। বিশেষ কোনও বলার মতো কাজকর্ম করে না। অতএব এই শহরতলি ছাড়া গতি নেই।

রঙ্গমঞ্চে এবার দ্বিতীয় পাকিস্তানির প্রবেশ। সে গুগল ম্যাপ নেড়ে চেড়ে বলল,“এ তো অনেক দূর”। ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে আটটা। তার কথামতো দুটো বাস নিতে হবে পৌঁছতে গেলে। সময়টা জুনের শেষ, জুলাইএর শুরু। রমাদানের সময়। সূর্যাস্ত প্রায় হবে হবে। তাই রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে উপবাস ভঙ্গের প্রস্তুতি চরমে। ক্রমশই ভীড় বাড়ছে। দুই বন্ধু বলল,“আসুন আমাদের সাথে। আগে কিছু খেয়ে নিন”। আমি বললাম, “দয়া করে আগে হোটেলে পৌছতে চাই। খাওয়ার কথা এখন ভাবতেও পারছি না। তাছাড়া আমি খেলেও আপনারা তো খেতে পারবেন না সূর্য ডোবার আগে। তাই কোন প্রশ্নই উঠছে না”। 

মনে মনে এও ভাবছি এ কাদের হাতে নিজেকে সঁপে দিচ্ছি? এদেরকে বিশ্বাস করছি কোন ভরসায়? যদি অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে...? কিন্তু আমার অন্য উপায়ই বা কী! না হলে তো মেট্রো স্টেশনে রাত কাটানো নয় ফিরে যাওয়া! কী কেলেঙ্কারি কাণ্ডই না হবে তাহলে! আর ফিরবই বা কিভাবে? আমার তো ফেরার টিকিট কাটা নেই। ফেরার কথা বসের সাথে গাড়িতে। মানে আক্ষরিক অর্থেই “ও মাসিইইই ও শিবুদাআআআ” বলে পা ছড়িয়ে কাঁদা ছাড়া আমার কাছে আর সব রাস্তাই বন্ধ। আমি তখন প্রায় কোমায়! 

বাস এল। দুই সম্পূর্ণ অপরিচিত পাকিস্তানির সাথে “মা ভৈঃ” বলে উঠে পড়লাম। তার আগে আমার হাতের ভারী সুটকেস তাদের কাছে চলে গেছে। আমার টিকিটও তারাই কাটল। টাকা নিল না। বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ চলেছি খেয়ালই নেই। আসলে আমি বোধহয় আর বেঁচে নেই! কান্না পাচ্ছে। অসহায় বোধ করছি। কিন্তু কেমন এক ঘোরের মধ্যে রয়েছি। যা হচ্ছে মেনে নিচ্ছি। হঠাৎই মনে হল কারা যেন হাত নাড়ছে। বুঝলাম পরের স্টপে নামতে বলা হচ্ছে আমায়। নামার পর জানলাম দ্বিতীয় বাসের নাকি প্রয়োজন নেই। ম্যাপ দেখে বোঝা গিয়েছে হেঁটেই পৌছনো যাবে হোটেলে। সে কি! প্ল্যান বদলে গেল এরই মধ্যে? তাহলে কি বাসে আমার থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে এরা দুজনে আরও খারাপ কোনও মতলব...?। 

তারা দুজনে সামনে সামনে, আমি খানিকটা দূরত্বে তাদের পিছন পিছন। রাস্তায় কোনও দ্বিতীয় প্রাণী নেই। দুপাশের বাড়িগুলো দেখে বুঝতে পারছি সোশাল হাউজিং।ঘড়িতে তখন রাত দশটা। “ছায়া ঘনাইছে বনে বনে”। অদ্যই হয়তো শেষ বিকেল! এইসব ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ চলেছি জানি না। আমি তখন অর্ধমৃত। যাতায়াতের ক্লান্তি আর শেষ তিন-চার ঘন্টার চাপা উদ্বেগ তখন আমার শরীরে ও মনে তাদের থাবা বসিয়েছে। ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত আমি তখন ভীষণ কঠিন এক পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলেছি। 

এরকম মানসিক ও শারীরিক অবস্থায় নিজেকে টেনে নিয়ে চলেছি কতক্ষণ খেয়াল নেই। হঠাৎ শুনি তারা পিছন ফিরে বলছে- “এই হোটেলটাই কি?” হ্যাঁ, নামটা তো মিলে যাচ্ছে! এটাই সেই বাড়ি! একবার আমার হাতের কাগজ, একবার বাড়ির গায়ে লেখা নাম, আর একবার ওদের মুখ দুটো...। আমার আর কিছু মনে নেই। চোখ তখন ঝাপসা। সেই ঝাপসা চোখে জলছবির মতো দেখতে পেলাম তারা আমার সুটকেসটা নামিয়ে রেখে আমায় বিদায় জানাচ্ছে। আমি তাদেরকে বলছি, “কীভাবে যে আমি আপনাদের ঋণ ...নেদারল্যান্ডস বা ইন্ডিয়া এলে আমাদের বাড়িতে কিন্তু অবশ্যই উঠতে হবে”। ফোন নাম্বার আদান প্রদানের শেষে যে রাস্তায় এসেছিলাম, সেই রাস্তাতেই তারা ফিরে গেল। যেন দুই দেবদূত। আমার প্রতিবেশী শত্রু রাষ্ট্র থেকে এসেছিল!

আমি হোটেলে চেক-ইন করলাম। খাবার অর্ডার দিলাম। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে দশটা। সূর্য অস্ত গেল। 

প্রায় ছ' হাজার দুশ কিলোমিটার দূরে ওয়াঘা বর্ডারে তার বেশ কিছুক্ষণ আগেই নামানো হয়েছে ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের পতাকা। ভিড় জমেছিল বিটিং রিট্রিট দেখতে।




সৌমী ব্যানার্জী
১৯৯৪


3 comments:

  1. পরের বার কালো কালিতে গোটা গোটা করে লিখে স্ক্যান করে দেবে। আর একটাও ইংরিজি শব্দ ব্যবহার না করে। :D
    আমার লেখাটা পড়লে না যে বড়। আমরা তো একই বৃন্তের দুটি কুসুম :P

    ReplyDelete