ইশকুলের পরীক্ষা!



দোয়েলপাখি দাশগুপ্তঃ সাইক্লোস্টাইল মেশিনটার কথা মনে আছে? ম্যাপঘরে থাকত? দেখতে সেলাই মেশিনের মতো! হাফ-ইয়ার্লিতে হাতে লেখা প্রশ্ন এবং কঠিন। অ্যানুয়ালে ছাপা এবং তুলনামূলক সহজ।

চিরশ্রী মজুমদারঃ আমরা মায়ের মেয়ে সবাই মিলে মাকে পুজিব!

দোয়েলপাখিঃ হাহাহাহা! এই গানটা প্রথম যেদিন হল আমি তো হকচকিয়ে গেছি। স্তবগুচ্ছে তো নেই! তখন ক্লাস ফাইভের হাফ-ইয়ার্লি। তারপর ছোট্ট গান অচিরেই মুখস্থ হয়ে গেল! পরীক্ষার ওই কটাদিন একটা ঝুঁটি অ্যালাউড ছিল। যদিও আমাদের অনেকেরই সেসবের বালাই ছিল না। ছোট চুল ছিল আজীবন।

চিরশ্রীঃ এই গানটাকে ভীষণ ভয় পেতাম! এমনি দিনে গাইতে বললেও পরীক্ষার গন্ধ পেতাম।

দোয়েলপাখিঃ এমনি দিনে কোনওদিন গাইতে হয়নি! বালাই ষাট!

চিরশ্রীঃ এই পরীক্ষার থ্রেডটায় কে কে লাইক করে দেখি!

সহেলি চক্রবর্তীঃ আবার এখানেও পরীক্ষা! সবাই ভয় পেয়ে গেছে মনে হয়।

দোয়েলপাখিঃ যারা লাইক করার, কেউ এখানে বসে সময় নষ্ট করছে না আসলে। কাজে ব্যস্ত! হিহি। জানিস তো আমাদের মাধ্যমিকের সিট পড়েছিল আদি মহাকালী পাঠশালায়। সেখানেও আমরা এই গানটা গেয়ে প্রার্থনা করেছি। তখন অবশ্য জোর পেয়েছিলাম। ততোদিনে কৈলাসপ্রাণা মাতাজি বড়দি হয়ে গিয়েছেন, মানে মীরাদি। বড় মিনুদি (প্রব্রাজিকা মৈত্রীপ্রাণা মাতাজি) তখন ভুবনেশ্বরে থাকতেন। আমাদের জন্য পুজোর ফুল নিয়ে এসেছিলেন পরীক্ষার সেন্টারে। খুব ভালবাসতাম মিনুদিকে। শ্রদ্ধা আর ভালবাসা মিলে এমন একটা জায়গা ছিল! একবার ক্লাস সিক্সে পরীক্ষার সময় দিদির অলউইন ঘড়ি নিয়ে গেছি। ডেস্কে পাশে ঘড়ি রেখে লিখছি। বড় মিনুদি এসে সবার কাছ থেকে ঘড়ি চেয়ে চেয়ে নিলেন। আমিও দিয়ে দিলাম। তারপর একসময় ঘন্টা পড়ে গেল। করুণ মুখে অফিসঘরের দিকে তাকিয়ে আছি। দেখি দিদি বাইরে এসে হাত নেড়ে আমায় ডাকছেন। একবারও কিন্তু বললেন না যে আর পরে এস না। অদ্ভুত ধরন ছিল ওঁর শিক্ষা দেওয়ার।

মধুজা ব্যানার্জীঃ মনে আছে একবার ক্লাস নাইনে অ্যানুয়ালের সময় আমাদের ইতিহাস খাতা হারিয়ে গেছিল? কোনও একটা সেকশনের। গার্জিয়ান কল করে জানানো হয়েছিল। তারপর কীভাবে যেন মার্কস ক্যালকুলেট করে ক্লাসে তোলা হয়েছিল সবাইকে।

রুনা মুখার্জীঃ একবার ক্লাস সিক্সে পড়তে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন দেখি স্কুলবাসে আমাকে ছাড়া আর ঠিক চারজন! বাকি সব্বাই ডুব। আমাদের আরও মন খারাপ হয়ে গেল। বাসে সিনিয়র ছিল এইটের তিস্তাদি। খুব দুষ্টু ছিল। আমাদের বাস-ড্রাইভার ছিলেন বুলবুলদা। খুব ভালবাসতেন সবাইকে। আমরা সকলে মিলে ওঁকে ধরলামবেচারা আর কী করে! সবাই মিলে ফন্দী করে যে যার বাড়ি ফিরে গেলাম। বাড়িতে তো সবাই অবাক! গল্প বললাম যে বাস খারাপ হয়ে গেছিল আর সারাতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। তাই ফিরে এলাম। তারপর সারাটা দিন ভাইয়ের সঙ্গে ছাদে হুটোপাটি...

মধুজাঃ একবার অ্যানুয়ালে পরীক্ষার আগে যারা স্কুলবাসে বসে বসে পড়া করছিল, প্রেয়ার শেষ হওয়ার আগে লেট-লাইনে এসে দাঁড়িয়েছিল... তাদের সবাইকে শাস্তি দিয়ে দেরীতে পরীক্ষায় বসানো হয়েছিল। সবাই খুব ভয় পেয়ে গেছিল। আমি যদিও খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। এমনিই ব্যাকবেঞ্চার। বাজে নম্বরের একটা ভাল অজুহাত তো পেলাম অন্তত! বাড়ি ফিরে রঙ চড়িয়ে মাকে গল্প করেছিলাম।

দোয়েলপাখিঃ স্কুলের পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে তখন অনেকগুলো বিষয়ে খুব রাগ হতো। যেমন, একই দিনে দুটো করে পরীক্ষা। তাও আবার অদ্ভুত কম্বিনেশনে! ইতিহাসের সঙ্গে ফিজিকাল সায়েন্স, অঙ্কর সঙ্গে সংস্কৃত। মাঝে কোনও ছুটি থাকবে না। হুড়মুড় করে পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। পরীক্ষার সময় ঘড়ি দেখা যাবে না। এই চাপের অভ্যাসে পরবর্তী জীবনে বড় বড় পরীক্ষার চাপ আর গায়েই লাগেনি আমাদেরতখন রুটিন, প্রিপারেশন সবই কত সহজ মনে হতো। ঘড়ি দেখতে না দেওয়ার কারণে সময়ের আন্দাজ এবং দ্রুত লেখার অভ্যেস দুইই তৈরী হয়েছিল। মনে পড়ে যখন সময় ঘোষণা করা হতো, সমস্ত পরীক্ষার হল জুড়ে একটা সমবেত হিঁইইই স্বরে চাপা আর্তনাদ উঠত! মাধ্যমিকের আগে গোটা নাইন আর টেন জুড়ে যেভাবে আমাদের তৈরি করা হতো অবাক লাগে ভাবলে!! কী সুন্দর করে, সিস্টেম্যাটিক করে। প্রতি পাতার ডানদিকে ও নীচে মার্জিন ছেড়ে লেখা, হেডিং-সাবহেডিং আলাদা আলাদা কালিতে... ইতিহাসের মতো বিষয়ও পয়েন্ট করে করে এবং পারলে ম্যাপসহ লেখা...ফিজিকাল সায়েন্সে প্রয়োজনমতো সার্কিট আঁকা, ভূগোলে সম্ভব হলেই পাশে একটা ছোট ম্যাপ এঁকে দেওয়া... আর স্বরূপাদির বাংলা ব্যাকরণের সেই মডেল! চিরস্মরণীয়!! পরীক্ষকদের কথা ভাবি। তাঁরা দেখতেন একটা স্কুলের মেয়েদের খাতা পরপর ছবির মতো সাজানো। যেমন সুন্দর হাতের লেখা তেমন পরিচ্ছন্ন। এত এত নম্বর উঠবে না কেন!

পৌলমী মুখার্জীঃ আমরা মায়ের মেয়ে গানটা এখনও কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লে বা পরীক্ষার আগে গাই। মনে অদ্ভুত জোর আসে। তোমরা প্লিজ হাসাহাসি কোরো না। মেডিকাল ছাত্রী তো। পরীক্ষা দেওয়া আমার আজও শেষ হয়নি। মাধ্যমিকের আগে শ্রীশ্রীমায়ের জন্মদিনে ভোগ খাওয়ানো হতো। আর সরস্বতী পুজোয় স্পেশাল পায়েস।

দোয়েলপাখিঃ হ্যাঁ, আর সরস্বতী পুজোর পরদিন মাধ্যমিকের ছাত্রীরা বরণ করত। শাড়ি পরে যাইনি বলে আমায় বরণ করতে দেননি। খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। তবে রেজাল্ট ভাল হয়েছিল। হিহি

শর্মিলা রায়ঃ ক্লাস টেনের প্রিটেস্টের ইতিহাস পরীক্ষার দিন ভীষণ বৃষ্টি! উল্টোডাঙ্গায় এক হাঁটু জল। এদিকে নতুন শাড়ি পড়েছি। শাড়ি উঁচু করে জল এড়াতেও লজ্জা করছে। কোনওমতে রিক্সা আর অটো করে যখন স্কুলে পৌঁছলাম সপসপে ভিজে গেছি। সবাই আসতে পারেনি বলে পরীক্ষা ক্যান্সেল হয়ে গেল। কিন্তু যারা এসেছিল সবাইই শাড়ি পরে, কেউ স্কার্ট পরেনি। দিদিরা অবাক। আমাদের তো আসলে ভয় ছিল স্কার্ট পরে এলে যদি পরীক্ষা দিতে না দেয়!

লোপামুদ্রা কুন্ডুঃ ক্লাস টেনে একবার হাফ-ইয়ার্লির সময় চল্লিশ মিনিট পরে পৌঁছেছিলাম। বিটি রোডের কুখ্যাত জ্যাম! তখন বড়দি ছিলেন মীরাদিওই সময়ে আমাকে ব্যাগ নিয়ে হেলেদুলে স্কুলে ঢুকতে দেখে এত অবাক হয়েছিলেন যে আর বকতে পারেননি।


পরীক্ষার খাতা বাঁধার সেই একফালি সুতো



শর্মিলা রায়ঃ আমাদে পরীক্ষার খাতায় বাঁধার সেই একফালি সাদা সুতো... এক্সট্রা পেজ নিলে যা দিয়ে সবকটা পাতার কান বেঁধে দিতে হতো... দিদিরা শৈল্পিকভাবে একতাড়া সুতো থেকে একটা সুতও আলাদা করে হাতে ধরিয়ে দিতেন! আজ সেই সুতোটার কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল।

নীলাঞ্জনা দ্বিবেদীঃ হ্যাঁ খুব  ভালই মনে আছে। আমার হাতের লেখা খুব বড় বড় বলে অনেক পাতা লাগত। একবার বড় অর্চনাদি গার্ড দিচ্ছিলেন। দুটো সুতো চেয়েছিলাম, যদি একটা ছিঁড়ে যায়, যাতে আর একটা দিয়ে বাঁধতে পারি। বলেছিলেন কাগজ আর সুতও দুটোরই অপচয় করছ। তবে দিয়েছিলেন দুটোই।

শর্মিলাঃ হ্যাঁ আমারও মনে হতো, ওই ফিনফিনে সুতোয় যদি আমার মহামূল্য সব আন্সার শীট হারিয়ে যায়! অনেকে আবার সুতোর ভরসা না করে স্টেপলার নিয়ে আসত।

নীলাঞ্জনাঃ আমাদের সময় স্টেপলারের চল ছিল বলে মনে পড়ছে না। তবে শর্মিলাদি বা মানসীদি গার্ড দিলে নিজেরাই দু-তিনটে করে সুতো দিয়ে দিতেন।

শর্মিলাঃ ছোটবাড়িতে রুলটানা খাতা ছিল। বড়বাড়িতে সাদা খাতায় বাংলা পরীক্ষা দিতে গিয়ে বেশ বড় বড় লাগত নিজেকে। ক্লাস ফাইভে ইংলিশ-এর উত্তর দিতে হতো প্রশ্নপত্রেই। কালি সোক করবে বলে ডটপেনে লেখার পারমিশন।

দ্বিজাবন্তী ঘোষঃ আমার হাতের লেখা কোনও পেনেই শুধরাত না। সবসময় শুনতাম। মায়ের মুক্তাক্ষর আর তোমার দ্যাখ! যেন আরশোলার ঠ্যাঙে কালি দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে!

সৌমী ব্যানার্জিঃ আমার রুমে একবার কাকলীদি গার্ড পড়েছিলেন। আমি কিছুতেই সুতও দিয়ে খাতাটা বেঁধে উঠতে পারছিলাম না। দিদি শেষ মুহূর্তে বলেছিলেন, নিজে যা পারবে সেভাবেই বেঁধে দাওআমি খোলা অবস্থায় খাতা জমা দিয়ে দিলাম। খাতা দেখার পর সোমাদি নম্বর দিয়ে বলেছিলেন, পুরো খাতার নম্বরটা দেব নাকি খুলে যাওয়া পাতাগুলোর?

চান্দ্রেয়ী লাহিড়ীঃ কেউ কেউ আধ ঘন্টা কী চল্লিশ মিনিট হতে না হতেই পাতা নিতে শুরু করত! আর আমরা আহত বাঘিনীর মতো তাদের দিকে চেয়ে থাকতাম আর ভাবতাম আজ বোধ হয় আমার পাতা ফুরাবেই না।

সুশান কোনারঃ আমার ভয়ানক খুদি খুদি হাতের লেখা। এমনকি বাংলা বা ইতিহাসেও কখনও এক্সট্রা পাতা বা সুতো লাগত না। তখন দুর্ধর্ষ লোডশেডিং-এর যুগ। লন্ঠনের আলোয় ওই লেখা উদ্ধার করতে দিদিরা নাজেহাল হতেন। বাংলায় তো ভারতীদি খাতার ওপর লিখলেন হাতের লেখার জন্য ৫! ক্লাস টেনে তারপর যিনিই গার্ড দিতেন, অমল ও দইওলার স্টাইলে বলতেন, পাতা চাই পাতাআআআ? ইদানিং অবশ্য সই করা ছাড়া কিছুই প্রায় আর হাতে লিখি না। তাই চলে যাচ্ছে।

শ্রাবণী দাসঃ থ্যাঙ্ক অই সুশানদি! ভারতীদির কথা মনে করালে! ওঁর কথায় একটা মজার কথা মনে পড়ে গেল। তখন শ্যামবাজার এলাকায় প্রচুর ক্যাসেটের দোকান ছিল। এলাকাটা দিয়ে ক্রস করা যেত না। কানে তালা লেগে যেত! বাংলা গানের প্রসঙ্গ উঠলে ভারতীদি বলতেন, আজকাল বাংলা গান মানে এস সখী দোপাটি বনে পাটি পেতে বসি! হিহি

সহেলি চক্রবর্তী সুতোটা আমি যত্ন করে পেন্সিলবক্সে ঢুকিয়ে রাখতাম। দেখলেই মনে হতো উড়ে যাবে।

দ্বিজাবন্তীঃ আমি একটা গল্প বলি। আমি যখন ক্লাস টেন তখন আমাদের বাড়িতে একটা ছোট্ট বেড়াল এল। তার নাম গাবলি। সে মহা আদরে থাকত। এক রাতে মা সোফায় বসে আছে, সোফার পিছন থেকে গাবলিরই খেলার জন্য একটা দড়িতে দেশলাই বাক্স বাঁধা। আমি ঘুরে ঘুরে পড়ছি। গাবলি অনেকক্ষণ দেশলাইবাক্সকে নাড়াচাড়া করে কাল্পনিক প্রতিপক্ষ ভেবে লড়াই করল। তারপর যেই ঘুম পেয়েছে অমনি মায়ের কোলে ওঠার জন্য হাঁচোড়পাঁচড় করতে শুরু করল। তখন ২-৩ মাসের বাচ্চা। খুবই আদুরে। আমি শুনতে পাচ্ছি মা ধমক দিচ্ছে, গাবু ডিসটার্ব কোরো না, আমি কাজ করছিতারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ। আমি শুতে চলে গেলাম রাত দেড়টা দুটোয়। হঠাৎ শুনি মায়ের চীৎকার! তাড়াতাড়ি নীচে নেমে দেখি, সোফার ওপর যে খাতাগুলো রাখা আছে, যেগুলো মায়ের দেখা হয়ে গেছে, তার প্রত্যেকটার ওই একফালি সাদা সুতো-র গিঁট সে খুলে রেখেছে সরু সরু নখ দিয়ে! খাতা ছেঁড়েনি, কোনও ক্ষতি করেনি। শুধু নিজের স্কিলটা দেখিয়ে দিয়েছে। সাদা সুতো বললে এই গল্পটাই আমার সবার প্রথম মনে পড়ে।

শবনম ঘোষঃ উফ! টু মাচ দ্বিজাবন্তী! মানসীদির কী রিয়্যাকশন ছিল রে?

দ্বিজাবন্তীঃ মা খুব চেঁচাল। কার ওপর জানি না। আসল ব্যক্তি তখন সোফার তলা থেকে টুকি করছে! সব খাতা চেক করে বেঁধে তুলল। এর পর থেকে খাতা দেখে সোজা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখত।

সহেলীঃ দ্বিজাবন্তীদি, তোমার গাবলিও বুঝেছিল ওই সাদা সুতোর মাহাত্ম্য! আমাদের মতো কতই না যত্নে খুলেছে!! হাহাহাহা


রেজাল্ট বেরনোর দিনগুলো


দেবলীনা পালঃ কেমন ছিল সেই দিনগুলো মনে পড়ে?

নীলাঞ্জনা দ্বিবেদীঃ আমি ওই একটি দিন লঞ্চ থেকে নামার সময় দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের দিকে তাকিয়ে প্রণাম ঠুকতাম আর বলতাম ইংলিশে পাশ করিয়ে দাও।

দোয়েলপাখি দাশগুপ্তঃ হাফ-ইয়ার্লির রেজাল্ট বেরনোর দিন ছিল অন্যরকম। শক্ত প্রশ্ন কিন্তু সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি ভাল হতো। কারণ বছরের শুরুর দিকে পড়াশোনার উৎসাহ এনার্জি সব বেশি থাকত যা ক্রমশ মিইয়ে আসত শেষের দিকে। কাজেই রেজাল্টের প্রতি একটা ঔৎসুক্য থাকত। কিন্তু অ্যানুয়ালের সময় খুব অপ্রীতিকর অবস্থা হতো। রেজাল্ট বেরনোর আগে অবধি নানান গল্প করে কেটে যেত। কিন্তু রেজাল্ট বেরনোর পর ক্লাসের বিভিন্ন দিক থেকে কান্নার আওয়াজ...ওটা আমাকে এখনও হন্ট করে। কেমন যেন অসহায় আর অপরাধী লাগত নিজেকে। যারা কাঁদছে, তারা অনেকেই আর পড়বে না জানি আমাদের সঙ্গে। তাদের সাথে সেই দিনটাই শেষ দেখা...

মন্দাক্রান্তা দাশগুপ্তঃ আমরা যখন ক্লাস সেভেনে পড়তাম, তখন থেকে আদেশ হল রেজাল্ট আনতে যাবে গার্জিয়ানরা। আমাদের কাউকে যেন স্কুলের পাড়ার আশেপাশে দেখা না যায়। কারণ তার আগের ব্যাচের বোধ হয় কেউ একজন রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় সেটি নিয়ে সোজা গঙ্গার ঘাটে চলে গিয়েছিল যাই হোক, আমার রেজাল্ট আনতে যেতেন আমার মা। মাকে বলে রাখতাম, কোনও নম্বর দেখার দরকার নেই। শুধু রেজাল্টের বইটা একটু ফাঁক করে দেখে নেবে উত্তীর্ণ লেখা আছে কিনা।  

সুস্মিতা ধর লুকাসঃ রেজাল্ট নামক বিভীষিকা এখনও রাতের ঘুম কেড়ে নেয় আমার। এখনও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি স্কুলের পরীক্ষায় লিখতে পারছি না আর ফেল করেছি। এ মনে হয় শেষ জীবন পর্যন্ত থাকবে। তার মানে কিরকম চাপে রাখত স্কুল বাপ রে বাপ! আমি আবার সংস্কৃতে প্রায় ফেলের পর্যায়ে পড়তাম। না হতো মুখস্থ না ঢুকত মাথায়। ক্লাস এইটে তো আরও বীভৎস। গাদা গাদা মেয়েকে ফেল করানো হতো। সেটা আর এক আতংক ছিল।

দেবস্মিতা সাহাঃ সব ভুলে গেছি বাবা! কিস্যু মনে নেই। এসব আবার মনে করায় নাকি কেউ!!

সায়নী রায়ঃ বীভৎস ছিল আমার জন্য। প্রতিবার রেজাল্ট বেরোত আমার জন্মদিনের আশেপাশে। ওই সময় একটাও জন্মদিন ভাল কাটাইনি। রেজাল্ট বেরোলে যা খেতাম মার কাছে, জন্মদিনের খাওয়া হয়ে যেত!

পাপিয়া ঘোষ বারুইঃ বেশিরভাগ সময়েই সেদিন মা আমার সঙ্গে যেতেন। কারণ জানতেন গার্জিয়ান কল হবেই।

অর্চিতা নাথ খানঃ বাবা মায়ের হাতে রেজাল্ট দেওয়া হতো। আর আমরা বাড়ি বসে ভির্মি খেতাম। এই বুঝি তল পেলে, ফের হারালে জাতীয় অনুভূতি আর কী!

অনিন্দিতা দে মারিকঃ কত বাবা মায়ের যে হাই প্রেশারের কারণ ছিল আমাদের স্কুলের রিপোর্ট কার্ড!

দ্যুতি মুস্তাফিঃ প্রথমদিকে ঠিকঠাক রেজাল্ট হলেও পরের দিকে তলিয়ে যাচ্ছিলাম ক্রমশ। আমিই রেজাল্ট আনতে যেতাম। মা বাড়িতে থাকতেন, কুঁকড়ে। কাছের ফোনবুথ থেকেই আগে ফোন করে মাকে জানাতাম, একটা স্বস্তি একটা আনন্দ! আজ বুঝি মাঝারি মাপের পড়ুয়াদের বাপ-মা হয়ে ওঁদের কী জ্বালা ছিল। আমি হলে তো সহ্য করতে পারতাম না।

সায়নী সেনগুপ্তঃ মা প্রাণ হাতে করে রেজাল্ট আনতে যেতেন। আর আমি গেটের আওয়াজ পেলে গম্ভীর মুখে ঘরে বসে থাকতাম। আজও রেজাল্ট বেরলে অত ভয় হয় না, তখন যেমন হতো।

পৌলমী সান্যালঃ ক্লাস নাইনের রেজাল্ট আনতে গেছে মা। দাদুর জন্যে খাবার করে রেখে গেছে। আমি ভুলেই গেছি এদিকে, টেনশনে। ফোনে যখন মা জানাল যে পাশ করে গেছি, তখন সম্বিত ফিরে দাদুকে খেতে দিলাম!
দেবাদৃতা মুখার্জীঃ শুধুই ওপরের দিকে ভাঁজ করা খাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তখন তো একেবারে ভাল লাগত না। কিন্তু এখন ওই মুহূর্তগুলোও খুব মিস করি।

1 comment: