উঠোন


ক্লাস ফাইভ থেকেই টিফিন খাওয়ার তাড়াটা বেড়ে গেছিল একলাফে। কোনওমতে মায়ের দেওয়া রুটি আর সাদা-সাদা আলুর চচ্চড়ি মুখে পুরেই দৌড়। সিঁড়ি দিয়ে একছুটে নীচে, ঠাকুরদালানের উঠোন। সিমেন্টের উঠোনে চৌকো খোপ খোপ। কবাডি থেকে ছোঁয়াছুঁয়ি - সবই ওই চৌকোর দুনিয়ায়। আমি খুব ছটফটে ছিলাম বলে সোমাদি আমায় ক্লাস থেকে বেরিয়ে একটু আকাশ ছুঁয়ে আসার সুযোগ করে দিতেন - 'মধুবন্তী, যাও ডাস্টার ঝেড়ে আন' বলে। আর আমিও মহা আনন্দে ডাস্টার বগলে এ সিঁড়ি ও সিঁড়ি ঘুরে উঠোনে নেমে অনেক সময় ধরে দেওয়ালের গায়ে ঝাড়তাম ডাস্টারের সাদা ধুলো। এমনকি উঠোনের সেই ধাপে ডাস্টার ঝেড়ে ঝেড়ে নকশা তৈরির চেষ্টাও করেছি। তখন আমার ডাস্ট অ্যালার্জি জাতীয় সমস্যা ছিল না। আসলে, তখন আমার কোনও অসুখই ছিল না।

আসল মজা হতো আলপনা পরীক্ষার দিন। ক্লাস এইটের আলপনা পরীক্ষায় উঠোনের প্রতি দুটো খোপ বরাদ্দ থাকত প্রতি ছাত্রীর জন্য। সবাই নিজের নিজের মতো আলপনায় ভরে তুলত খোপদুটো। ওপরের বারান্দায় দাঁড়ালে সে এক দৃশ্য! সে ছাড়াও ১৫ই আগস্টের অনুষ্ঠানে ড্রিল হত সেই উঠোনে। ১২ই জানুয়ারি প্রতিবেশী অনেক স্কুলের ছেলেমেয়েরা আসত অনুষ্ঠান করতে। আমরা একটা চাপা আদারনেস নিয়ে উঠোনের কোণে বসে থাকতাম। আসলে এই সেন্স অফ সুপিরিয়রিটি' আমাদের অসুখ ছিল না। ওটা সে সময়ের একটা দৈনন্দিন ইঞ্জেকশন ছিল। কিন্তু সেটুকু ছাড়া বাকিটা এক্কেবারে অনাবিল। ওই উঠোনের ওপর বার্ষিক অনুষ্ঠানের প্রথম দিনের পরিবেশনা হতোঅনেক অন্যায় দেখেছি সেখানে - সেই উঠোনের অনুষ্ঠান হওয়ার পর মঞ্চে যাওয়া থেকে বাদ পড়ে একটি মেয়ে, কারণ তার মাথায় উকুন। সেই উঠোনে দাঁড়িয়ে নিদান দেওয়া হয় একটি মেয়েকে মাথা নেড়া করার জন্য, কারণ তার পুজোর সময় কাটা চুলের নতুন বাহারে বেণী থেকে আলগা হয়ে আসছিল কিছু গুছিআবার ওই উঠোনেই একবার টিফিন বেলার আ-চৈ-চৈতে পড়ে গিয়ে আমার কোমরের হাড়ে চির-নড়বড়েপনায় আলতো হাতে বরফ লাগিয়ে দেওয়া দিদিমণির মধ্যে মায়াময় আঁচলের স্বাদ পেয়েছি। আমার স্কুলবেলার মধ্যে যা কিছুকে অন্যায় বলে জেনেছি, যা কিছুকে আদরের বলে জেনেছি, যা কিছুকে ভুল বলে জেনেছি, যা কিছুকে কর্তব্য বলে জেনেছি - তার অনেকটা জুড়ে ছিল আমাদের ঠাকুরদালান, উঠোন, স্কুলের রিক্ত-দীন-ছোট্ট অথচ মমতায় ভরা মাঠখানা....



আজ সকালে আমার বোন বলল উঠোনটাকে উপড়ে ফেলে মার্বেলের স্ল্যাব বসানো একটা চকচকে জায়গা করা হয়েছে নাকি। এত চকচকে যাতে খেলতে গেলে পা, ১৫ই অগাস্টের গান, ছেলেবেলা সব পিছলে যায়। আর ঠ্যাং ভেঙে পড়ে স্মৃতির দৌরাত্ম্য সব। যাক... দুষ্টু, চঞ্চল বাচ্চাদের আমাদের স্কুল কখনওই পছন্দ করত না। তবু আমার মত গোটা কয় দামাল বাচ্চা যেভাবে মাতিয়ে রেখেছিল স্কুলবাড়ি, তাতে করে তাঁদের বেশ নাকানিচোবানি খেতে হচ্ছিল বটে।

আমার মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, ঠিক ১০টার কাঁটা মিলিয়ে বৃন্দাবনদা যে হাতুড়ির ঘা দিত ঘন্টায়, তারপরেই ঠিক ৫ সেকেন্ড আমাদের ভেতর দিয়ে কী একটা বয়ে যেত, আর সবাই একসঙ্গে বলতাম ওঁ! কোনও ব্রাহ্মণ্যবাদের ছিঁটেফোঁটা ছিল না যে উচ্চারণে - আর আমাদের সমস্ত ক্লান্তি কেটে যেত, সেই ঘন্টা শুনে এই বেমানান মার্বেলের ওপরে দাঁড়িয়ে ওঁ বলতে শীত করে না আজকের পড়ুয়াদের?

আমার মনে পড়ে আমাদের এক শিক্ষিকা ক্লাসে পড়াতে পড়াতে বলেছিলেন,তোমরা ডেনিম পরলে আমরা কেন বকি, জান? কারণ, এই ছোট বয়সে ওই একটা ডেনিম বা একটা শার্ট দিয়েই ধীরে ধীরে বিশ্বায়ন তোমাদের গিলে খাবে। তোমরা নিজেদের ভুলে যাবে।' সেই মুহূর্তে স্কুলকে, ওই শিক্ষিকাকে খুব আপনার মনে হয়েছিল। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়, ওই চকচকে মার্বেলের উঠোনে দাঁড়িয়ে আজ আপনার কি একবারও বকতে ইচ্ছা করছে না, দিদি?


মধুবন্তী মিত্র [ ২০০৮]

8 comments:

  1. স্কুল নিয়ে সবসময় মনরাখা ভাল-ভাল কথা বলতে হবে, বিশ্বাস করিনি কোনওদিন। এ-লেখাটা গ্রুপে পড়ে থেকেই খুব প্রিয় ছিল। এমন সৎ লেখা রাখতে চেয়েছি অপাঠ্যে। বরাবর। থ্যাংক্স তোকে মধুবন্তী।

    ReplyDelete
  2. শেষ প্যারাগ্রাফটা! :'-)

    ReplyDelete
  3. সৎ ভাবে কথা বলার শিক্ষা মৌখিকভাবে স্কুল থেকে পেলেও সেই সুযোগ কার্যত পাওয়া যেত না। নিজের বাড়ি বা পরিবারকে ঘিরেও যেমন আবেগ-ভালবাসা-অনুযোগ-অভিযোগ থাকে, নিজের স্কুল কে ঘিরেও থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। চাপা পড়া আবেগের স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ খুবই মন ছুঁয়ে গেল।

    ReplyDelete
  4. মার্বেলের মেকওভারটা আমাদেরও পছন্দ হয়নি...সরস্বতী পুজোর ব্যস্ততায় আমরা ক'জন বন্ধু মিলে... উঠোনের কোণে লিখেছিলাম-"ভালো লাগছে না"... তারপরেই সেই অভিমান নিয়েই দাঁড়িয়েছি দোতলার লালবারান্দায়...


    লেখাটা খুব সত্যি...

    ReplyDelete